পনেরো
দোলন পর্ব
এক মনোরম গোধূলিবেলায় দেবু ঠাকুরের মনে পড়বে দোলনের কথা। ফাল্গুন মাস। দেবু ঠাকুর একাকী বেড়াতে গিয়েছিলেন পশ্চিমের মাঠের দিকটায়। গোধূলিবেলার আকাশ সেদিন কমলা রঙের। মাঠের দিকটা নির্জনে পড়ে ছিল। পায়েচলা পথে ছিল না মানুষের চলাচল। বিলের দিকটায় আমন-আউশের চারা বড় হচ্ছিল। পাট তিল কাউনের চারা বড় হচ্ছিল। বাঙ্গি তরমুজের জমিগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। সেই সব জমিতে গরু চড়াতে নিয়ে এসেছিল রাখালেরা। এখন কমলা রঙের আলোয় ভরে থাকা সেইসব জমি থেকে গরুর দল ফিরিয়ে নিচ্ছিল বাড়ির দিকে। হাওয়া বইছিল নদীর স্রোতের মতো। গরুর খুরের ধুলোয় গেরুয়া রঙের কুয়াশা ভাসছিল ওদিকটায়। হাওয়ায় ভেসে ভেসে সেই কুয়াশা গন্তব্য ঠিক করতে পারছিল না। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল।
আকাশ আর ধুলোর দিকে তাকিয়ে ঠাকুর বুঝলেন, জ্ঞানী-গুণী মহাজনেরা কেন এই সময়টিকে গোধূলিবেলা বলে গেছেন। গরুর খুরের ধুলো আর আকাশের শেষবেলাকার আলো মিলেমিশে সোনার বরন ধারণ করেছে। এই অপূর্ব আলোয় মিষ্টি একখানি মুখ ঠাকুরের চোখে ভেসে উঠল। তার ডাগর চোখের চাহনিতেও যেন মাখামাখি হয়ে আছে গোধূলিবেলার আলো। শ্যামল বর্ণের মুখখানি ভরে গেছে সেই আলোয়।
ঠাকুর মনে মনে বললেন, ‘তুমি ছিলে আমার গোধূলিবেলার আলো।’ তারপরই ভাবলেন, কোন সে আলো? কখন ওরকম আলোয় উদ্ভাসিত হয় যুবতী মেয়ের মুখ?
প্রেমে পড়লে?
সেই আলো কী প্রেমের ঐশ্বরিক আলো? ঈশ্বর-প্রদত্ত মোহন আলোয় হৃদয় পরিপূর্ণ হলে কী অমন হয় যুবতী মেয়ের মুখ? আলোয় ভরে থাকে চোখ দুখানি?
কার প্রেমে পড়েছে দোলন?
মুহূর্তকালের জন্য সেই গোধূলিবেলায় আরেক যুবতী কন্যার কথা মনে পড়েছিল ঠাকুরের। কিরণ। অন্য কোনো আলোর প্রয়োজন ছিল না তার। সে ছিল নিজের আলোয় পরিপূর্ণ। তনুমন ঠিকরে সারাক্ষণই তার বেরোত সোনালি বর্ণের আলো। সে ছিল ‘সোনার বরণি মেয়ে’।
তার সঙ্গে দোলনের কোনো তুলনা হয় না। দুজন দুরকমের সুন্দর। কিরণ পড়েছিল ঠাকুরের প্রেমে। বর্ষাকালের সেই বিকেলে নীলাম্বরী শাড়ি পরা কিরণের ওই একটি কথাতেই ঠাকুর তার প্রেমে পড়ার কথা বুঝেছিলেন। ওই একটি কথাতেই কিরণ তার প্রেমে পড়ার ইঙ্গিত পুরোটাই দিয়েছিল। ‘আপনি হিন্দু হলেন কেন?’
দোলনের কোনো ইঙ্গিত ছিল না। দেবু ঠাকুর তার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিলেন একদিন। সেও এরকম এক গোধূলিবেলা। ঠাকুরের সঙ্গে তখন প্রিয়নাথ। দুপুরের ঘুম সেরে চা নিয়ে বসেছেন ঠাকুর। রোগী সেদিন বেশি আসেনি। জনা তিনচারেক ছিল। দ্রুতই তাদের বিদায় করেছিলেন। মন কী রকম উদাস হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছেন চৌধুরীর ঘরের দিকে। চৌধুরী কালনা গেছে মাস দেড়েক আগে। সরস্বতী বুড়ি ডুবে মরার পর ঘরটা তালামারা থাকে। পড়ো পড়ো অবস্থা। এবার ফিরে এসে ঘরটা সে বিক্রি করে দেবে। ঠাকুরের সঙ্গে তার ঘরেই থাকবে। এমন কথা হয়েছে।
উঠানের তিন পাশে অনেক রকমের ফুলের গাছ। শিউলি কামিনী জবা গন্ধরাজ হাসনুহেনার ঝোপ, বেলি ফুলের ঝোপ। রক্তজবা ফুটে আছে অনেক। উঠানটি সবুজ ঘাসে ভরে আছে। গাছপালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে পশ্চিম আকাশ থেকে এসে পড়েছে গোধূলিবেলার কয়েক টুকরো আলো। অপূর্ব এক মায়াবী পরিবেশ।
সেখানটায় এসে চমকে গিয়েছিলেন ঠাকুর। চৌধুরীর ভেঙে পড়া ঘরের বন্ধ দুয়ারে উদাস হয়ে বসে আছে দোলন। তার মুখেও পড়েছে একটুখানি আলো। চোখে ভাবুক দৃষ্টি। কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরা। ঠাকুর বাড়িতে আসার পর সে আর স্কুলে যায়নি। বাড়িতেই নিজের মতো করে পড়েছে। লেখাপড়ায় তেমন ভালো না। তারপরও চেষ্টা করে গেছে। রতনপুর বাজার থেকে প্রতিবছরই ঠাকুর তাকে নতুন ক্লাসের একসেট করে বই এনে দিয়েছেন। ক্লাস নাইন আর টেনের একই বই। সেই বই দোলন তিন বছর ধরে পড়েছে। চাঁদপুরে পড়েছিল ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। ঠাকুরের কাছে আসার পর ক্লাস এইটের বই পড়েছে এক বছর। তারপর নাইন আর টেনের বই তার আর শেষই হচ্ছিল না।
সেই বিকেলে দোলনকে দেখে প্রথমে চমকালেন ঠাকুর। তারপর যেন তাঁর দৃষ্টি খুলে গেল। মনে হলো, দোলন হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছে। যৌবন তার শরীরে এসে ভর করেছে। ছোটখাটো স্নিগ্ধ সুন্দর মেয়েটি যেন আজ বিকেলে শরীর ভরা যৌবন নিয়ে চৌধুরীর বন্ধ দরজায় বসে আছে। যৌবন জোয়ার তাকে ভাসিয়ে নেওয়ার উপক্রম করছে।
দোলনকে দেখে যেমন চমকে উঠেছিলেন ঠাকুর, দোলনও ঠিক তেমন করে চমকালো।
চমকালো নাকি কেঁপে উঠলো!
ঠাকুর হাসিমুখে বললেন, ‘তুই এখানে একা একা বসে আছিস? কী ব্যাপার?’
দোলন উঠে দাঁড়ালো। ‘কিছু না। এমনি।’
‘এমনি এমনি কেউ এরকম নির্জন একটা জায়গায় একা বসে থাকে?’
‘আমি থাকি। আমার ভালো লাগে।’
‘এই বাড়িতে ভূত আছে জানিস না?’
দোলন হাসলো। ‘জানি।’
‘ভূতের ভয় নেই?’
‘না।’
‘বলিস কী? ভূতে ভয় পায় না এমন মানুষ আছে?’
‘থাকবে না কেন? আমিই তো আছি।’
‘তোর দেখি অনেক সাহস হয়েছে?’
‘তা হয়েছে।’
‘এত সাহস পেলি কোথায়?’
‘তোমার কাছে।’
‘আমার কাছে? বলিস কী?’
‘হ্যাঁ। আমার সবকিছুই তো তুমি।’
ঠাকুর অপলক চোখে দোলনের চোখের দিকে তাকালেন। শরীরের খুব ভিতরে তাঁর যেন কী রকম একটা কাঁপন লাগলো। কাঁপন নাকি ধাক্কা, তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না। মুহূর্তেই ব্যাপারটা সামলালেন। তরল গলায় বললেন, ‘সন্ধ্যার মুখে মুখে একা একা এদিকটায় আসবি না। ভূতে ধরবে।’
দোলন উদাস গলায় বলল, ‘ভূতে তো আমাকে ধরেছেই।’
‘ভূতে ধরেছে? মানে?’
‘মানেটা জানি। তোমাকে বলবো না।’
‘কেন বলবি না?’
‘আমার ইচ্ছা আমি বলবো না।’
‘ঠিক আছে বাবা, বলিস না। এখন চল, বাড়ি যাই।’
‘চলো।’
ঠাকুরের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে দোলন হঠাৎই তাঁর একটা হাত ধরলো। সেই স্পর্শে ঠাকুর কেঁপে উঠলেন। দোলন তাঁর হাত আগেও বহুবার ধরেছে। আজকের ধরাটা একটু যেন অন্য রকম মনে হলো ঠাকুরের। বুকে আবার সেই কাঁপন বা ধাক্কাটা লাগল। এই অনুভূতি আজ কেন হচ্ছে, কে জানে!
দোলন গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?’
ঠাকুর অবাক। ‘বিরক্ত হবো কেন?’
‘এই যে আমি তোমার হাত ধরেছি।’
‘তাতে কী হয়েছে? আমার হাত তো তুই ধরতেই পারিস।’
‘তা পারি।’
‘তাহলে?’
‘এমনি এমনি বললাম।’
‘তোকে আজ অন্য রকম লাগছে।’
‘কী রকম?’
‘এই তোকে যেন আমি আগে কখনো দেখিনি।’
‘সত্যি দেখোনি। আমি আজ সত্যি অন্য রকম। নতুন মানুষ।’
হাঁটতে হাঁটতে মুখ ঘুরিয়ে দোলনের দিকে তাকালেন ঠাকুর। ‘কী হয়েছে তোর?’
দোলনও তাকালো ঠাকুরের মুখের দিকে। ‘যা হয়েছে, তা তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না।’
‘বল তাহলে?’
‘না, এখন বলবো না।’
‘তাহলে কখন বলবি?’
‘জানি না। তবে বলবো নিশ্চয়।’
দোলন সে-কথা বলেছিল মাস দুয়েক পর। এক ঝড়ের রাতে।
বৈশাখ মাস। কয়েকদিন আগে চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা হয়ে গেছে কালিরখিলের মাঠে। ঠাকুর তাকে সঙ্গে করে মেলায় নিয়ে গিয়েছিলেন। দোলন যা যা কিনতে চেয়েছে, সবই কিনে দিয়েছেন। একটা কলাপাতা রঙের আর একটা নীল রঙের শাড়ি। সোনার নাকফুল কিনেছে। স্নো-পাউডার কাচের চুড়ি আর আলতা কিনেছে। লিপস্টিক আর গন্ধ সাবান কিনেছে। সুগন্ধি তেল কিনেছে। মুখ দেখার আয়না চিরুনি ক্লিপ চামড়ার স্যান্ডেল ইমিটেশনের গহনা। এতকিছু কিনে কী যে উৎসাহিত হয়েছিল। তারপর থেকে প্রতিদিন স্নান করার পর সুন্দর শাড়ি ব্লাউজ পরতো। হাতভর্তি চুড়ি। নাকে নাকফুল। গলায় সোনার একটা চেইন থাকতো। ভরিখানেক ওজনের চেইনটা ঠাকুর আগেই কিনে দিয়েছিলেন। কানের সোনার রিংও কিনে দিয়েছিলেন। ওগুলো সব সময় পরা থাকতো দোলনের। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস মেয়েটির। ঘুম থেকে উঠে সামান্য প্রসাধন করতো। স্নো পাউডার আর সুগন্ধি তেলের সুবাস সব সময়ই লেগে থাকতো তার শরীরে।
ঠাকুর সুগন্ধ পছন্দ করেন।
বৈশাখের শুরুর দিককার একদিন শেষ বিকেলে অন্ধকার হয়ে এলো চারদিক। আকাশের এদিক-ওদিক থেকে ঘন মেঘ এসে দাঁড়ালো ঠিক যেন দেবু ঠাকুরের বাড়ির ওপর। হাওয়া নেই। গাছের পাতারা থম ধরে আছে। মাটি আর গাছপালা থেকে গরম ভাপ উঠছে। প্রিয়নাথ বাড়িতে গেছে। আজ আর ফিরবে না। রোগীরা আকাশের অবস্থা দেখে দ্রম্নতই ফিরে গেছে।
দোলন থাকতো উত্তরের ছোট ঘরটায়। ঠাকুরের আর নিজের ঘরে হারিকেন জ্বালিয়েছে। ধূপ দিয়েছে। আকাশের অবস্থা দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল।
ঠাকুর তাঁর ঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘কালবৈশাখি হবে রে দোলন। অবস্থা ভালো না। ভয় পাবি না। ভয়ের কিছু নেই।’
ঝড় সে-রাতে ভালোই হলো। শুধু প্রকৃতির ঝড় নয়, দোলন আর ঠাকুরের জীবনেও এলো প্রবল এক ঝড়। সেই ঝড়ে রাতারাতি বদলে গেল দুজন মানুষের জীবন।
ঝড়টা শুরু হয়েছিল হঠাৎই। চারদিক থেকে এমন দমকা বাতাস এলো। যেন মুহূর্তে তছনছ করে ফেলবে সবকিছু। প্রবল ঝড়ে বৃষ্টির জোর টের পাওয়া যায় না। বৃষ্টিও ছিল মন্দ না। ঝড় আর বৃষ্টির তোড় ঘর-দুয়ার আর গাছপালা সব যেন উড়িয়ে নেবে। সব যেন লণ্ডভণ্ড হবে মুহূর্তে। গাছপালায় হাহাকার। এই ডাল ভেঙে পড়ছে, ওই গাছের মাথা উড়ে যাচ্ছে। বাঁশঝাড়গুলি নুইয়ে নুইয়ে পড়ছে। ফটাস ফটাস শব্দে ভেঙে পড়ছে। দোলনের ঘরের পিছনকার আমগাছটির একটা ডালা ভেঙে পড়ল চালে। এমন শব্দ হলো! ভয়ে আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে গেল দোলন। বাতাস যেন ফাঁদে পড়া বাঘ। গো গো গো গো করছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে। আমগাছগুলোতে বড় হয়ে উঠছিল আম। অবিরাম ঝরতে লাগল কচি আম। মুহূর্তে ভেঙেপড়া ডালপালায় ভরে গেল উঠোন। দোলন একসময় প্রচণ্ড ভয় পেল। দিকপাশ না তাকিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে একটা দৌড় দিলো।
দরজা বন্ধ করে ঠাকুর বসেছিলেন নিজের ঘরে। দোলন দৌড় দিয়েছে আর তখনই দোলনের ঘরের অবস্থা দেখার জন্য জানালার একটা পাল্লা কোনোও রকমে খুলেছেন। দোলনকে দেখে ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন। হেঁচকা টানে দোলনকে নিয়ে গেলেন ঘরের ভেতর। ওই সামান্য সময়েই ভিজে একেবারে জবুথবু হয়ে গেছে দোলন। শাড়ি লেপটে গেছে গায়ে। হারিকেনের আলোয় তার মুখখানি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ভয়ে আতঙ্কে ফ্যাকাশে মুখ। ঝড়ের তা-ব তখনো চলছে। দরজা ভেঙে সেই ঝড় যেন ঢুকে যাবে ঠাকুরের ঘরে, এমন অবস্থা।
অতিকষ্টে দরজা বন্ধ করেছিলেন ঠাকুর। ভেজা শরীর নিয়ে ভয়ে আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে দোলন জড়িয়ে ধরেছিল তাঁকে। ঠাকুরের ধুতি আর কোরা রঙের গেঞ্জি ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
এক হাতে দোলনকে জড়িয়ে ধরে ঠাকুর বললেন, ‘আগেই তো এই ঘরে চলে এলে পারতি। কী দরকার ছিল একা একা ওই ঘরে থাকার?’
ঠাকুরকে জড়িয়ে ধরার পর ঝড়ের ভয় উধাও হয়ে গেল দোলনের। তার শুধু মনে হলো, যতক্ষণ ইচ্ছা চলুক এই ঝড়। সব তছনছ করে দিক। এখন আর কোনো ঝড়ই তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। অথবা ক্ষতি করুক, মেরে ফেলুক তাকে। এভাবে ঠাকুরকে জড়িয়ে ধরে মরে যেতেও তার কোনো কষ্ট হবে না।
ঠাকুর বললেন, ‘সব ভিজিয়ে ফেলেছিস। এখন কী পরবি?’
দোলন জড়ানো গলায় বলল, ‘যা পরে আছি, তাতেই হবে।’
‘ভেজা শরীরে থাকলে জ্বর আসবে।’
‘আসলে আসবে। তুমি ওষুধ দিও। তোমার ওষুধে ভালো হয়ে যাবো।’
‘আবলতাবল কথা বলিস না। যা, আমার একটা ধুতি নিয়ে শাড়ির মতো করে পরে ফেল।’
‘বললাম তো দরকার নেই।’
‘দরকার আছে। আমি যা বলছি, তাই কর।’
ঠাকুরের কামরায় গিয়ে তাঁর একটা ধুতি শাড়ির মতো করে পরেছিল দোলন। পরে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল ঠাকুরের বিছানায়। বাইরের ঝড় ধীরে ধীরে কমে আসছে। বিদ্যুতের চমক ছিল। মেঘের গুরুগম্ভীর ডাক ছিল। ঝড় কমে আসার ফলে বৃষ্টির বেগ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। টিনের চালায় ঝমঝম ঝমঝম শব্দ তুলেছিল।
সেই কামরায় ঢুকে ঠাকুর তাঁর চেয়ারে বসলেন। টেবিলে জ্বলছে হারিকেন। দোলনের মুখে গিয়ে পড়েছে হারিকেনের আলো। দোলনের দিকে তাকালেন ঠাকুর। ‘রাতে রান্নাঘরে যাবি কেমন করে? খেতে হবে না?’
দোলন আসেত্ম করে বলল, ‘আজ রাতে খাবো না।’
ঠাকুর হাসলেন। ‘কেন? ভয়ে খিদা মরে গেছে?’
দোলন কথা বলল না।
ঠাকুর বললেন, ‘আমি তো রাত্রে এমনেতেই খাই না। এক গস্নাস দুধ খাই। ওটা না খেলেও চলে।’
দোলন এবারো কথা বলল না। অদ্ভুত এক চোখ করে তাকিয়ে আছে ঠাকুরের দিকে। তার দিকে তাকিয়ে সেই গোধূলিবেলার কাঁপনটি ফিরে এসেছিল ঠাকুরের শরীরে। সেই বিকেলের সেই ধাক্কাটি লেগেছিল বুকে।
দোলন অমন করে তাকিয়ে আছে কেন?
কী আছে তার চোখে?
ঠাকুর তারপর দেখতে পেয়েছিল যুবতী মেয়েটির শরীর। শাড়ি ছায়া বস্নাউজ বদলে সে পরে আছে ঠাকুরের ধুতি। সাদা ধুতির আড়ালে দেখা যাচ্ছে তার চালতার মতো স্তন। বেতফলের মতো উঁকি দিচ্ছে স্তনবৃন্ত। ধুতির আবরণ মানতে চাইছে না।
ঠাকুর চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কোথাও কি একটা পাপবোধ কাজ করছিল তাঁর। লতাপাতার সম্পর্কের হোক, মেয়েটি তাঁর ভাগ্নি। তার শরীরের দিকে কি এভাবে তাকানো যায়?
পাপবোধ ঠাকুরের ছিল, দোলনের ছিল না। সেই রাতে সে নিজের ঘরে ফিরে যায়নি। ঠাকুরের ঘরেই, তাঁর বিছানায় রয়ে গিয়েছিল।
ঠাকুর চিরযৌবনের মানুষ। কবে তাঁর যৌবনকাল শুরু হয়েছে, জানেন না। কবে শেষ হবে, জানার প্রশ্নই ওঠে না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরে ছিল কামরা। বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে দুজন মানুষ। ঠাকুর আর দোলন। অমন উদ্ভিন্নযৌবনা দোলন শুয়ে আছে পাশে। এই অবস্থায় পুরুষ মানুষের পক্ষে নিজেকে ধরে রাখা কঠিন। সেই কঠিন কাজটি ঠাকুর করে যাচ্ছিলেন। জোর করে ধরে রাখছিলেন নিজেকে। একসময় ঘুমিয়েও পড়েছিলেন।
ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল দোলন।
ঘুমের ভেতর ঠাকুর টের পেলেন এক হাতে গলা জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো তাঁর ঠোঁটে গালে আর গলায় বুকে মুখ ঘষছে দোলন। শ্বাস-প্রশ্বাস উষ্ণ। মুখে গোঙানির শব্দ। ঠাকুরের ধুতি গায়ে নেই …
ঠাকুরের শরীরও জেগে উঠেছিল তারপর। সম্পর্কের কথা আর মনে রাখেননি তিনি। দোলন তো আগেই তা ভুলেছিল।
ওইসব মুহূর্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য কোনো দিকে খেয়াল থাকে না পুরুষ মানুষের। মিলিত হওয়ার পর মনেই থাকে না কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে মেয়েটির। কোনো বোঝা বইতে হইতে পারে তাকে সারাজীবন।
ঠাকুর বুদ্ধিমান মানুষ। ঠান্ডা মাথার। দোলনের দিকটা মনে রেখেছিলেন। কমবেশি ঝড় সারারাতই চললো সেই রাতে। বৃষ্টিও চললো। একই অবস্থা চললো ঠাকুরের কামরায়। সারা রাতে পাঁচবার মিলিত হলো দুজন মানুষ। ক্লান্ত হয়ে ঘুমালো কিছুটা বেলা পর্যন্ত।
তখন ঝড় একেবারেই থেমে গেছে। বৃষ্টি পড়ছিল ঝিরঝির করে। সকালবেলার আলো ঘোলা জলের মতো ছড়িয়েছিল চারদিকে।
সেই রাত থেকেই শরীরের নেশায় মেতেছিল দুজন মানুষ। এক ঘরেই রাত্রিযাপন শুরু করেছিল। রান্নাঘরে প্রিয়নাথ শুয়ে পড়ার পরে, চারদিক সুনসান নীরব হয়ে গেলে চুপিচুপি নিজের ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসতো দোলন। শিকল তুলে দিত দরজায়। ঠাকুরের ঘরে এসে ঢুকতো। ভোরবেলা পাখিরা জেগে ওঠার সময় নিজের ঘরে ফিরে যেতো। ঠাকুর অসম্ভব যৌনক্ষমতার অধিকারী। প্রতি রাতেই দেহমিলন হতো তাদের। দোলনও যেন অনেকটাই ঠাকুরের মতো। তার চাওয়া ফুরাতেই চাইতো না। যেন একজন আরেকজনের শরীরে প্রবেশ করে সেই অবস্থায় পার করে দিতে পারে অনন্তকাল। শরীর বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজনই নেই।
এসব ঘটনা চাপা থাকে না। দিনে দিনে প্রিয়নাথ জানলো। ধীরেন চৌধুরী জানলেন। গ্রামের লোকজনও কেউ কেউ টের পেয়ে গেল। এই নিয়ে কথাবার্তা হয়। ঠাকুরের কানে আসে সবই। ততদিনে দুটি বছর কেটে গেছে। ঠাকুর সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে করবেন। ওই একটি মাত্র পথ আছে মানুষের মুখ বন্ধ করার। নিজে বিয়ে করবেন, দোলনেরও বিয়ে দেবেন।
তারপর মালখানগরের মেয়ে কমলরানী এসেছিলেন ঠাকুরের স্ত্রী হয়ে। তখনো দোলন রয়ে গেছে সংসারে।
দেবু ঠাকুরের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। সে-কথা কানে না আসার কোনো কারণ ছিল না দোলনের। তারপাশার বিখ্যাত ঘটক ব্রজলাল নিয়মিত আসা-যাওয়া করছিল ঠাকুরের কাছে। নিভৃতে বসে কথাবার্তা বলছিল। প্রিয়নাথ তাকে মিষ্টি আর চা খাওয়াতো। লোকটার বিড়ি টানার অভ্যাস ছিল। কুম্ভিপাতার বিড়ি টানতো ঘন ঘন। বিচ্ছিরি গন্ধ সেই বিড়ির। ঠাকুরের ঘর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসতো দোলনের ঘরে। গন্ধে বমিভাব হতো তার।
বাড়িতে ঘটক আসছে শুনে দোলন ভেবেছিল বুঝি তার বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়েছেন ঠাকুর। আগে লালমামা ডাকতো। প্রথমে ভালোবাসা। তারপর শরীরের সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার পর থেকে লালমামা বলে যখন-তখন ঠাকুরকে সে আর ডাকেই না। নিতান্তই বাধ্য হলে ডাকতো। তা-ও লোকজনের সামনে। একান্তে না। ওই যে গোধূলিবেলায় ঠাকুরের হাত ধরে চৌধুরীর ঘরের সামনে থেকে ফিরে আসার সময় যে-কথা একদিন শুধু ঠাকুরকেই বলবে, সেই কথাটা ঠাকুর এক রাতে জানতে চেয়েছিলেন।
ঠাকুরের বুকে মুখ রেখে শুয়েছিল দোলন। ঠাকুরের বাঁ-বাহু হয়েছে তার বালিশ। ডান হাতে ঠাকুর তার গালে মাথায় হাত বোলাচ্ছিলেন। গ্রীবা আর খোলা পিঠে হাত বোলাচ্ছিলেন। দোলনের খোলা স্তন ছুঁয়ে আছে ঠাকুরের বুকের একপাশ। দোলনের অন্য হাতটি ছিল তাঁর গলায়।
ঠাকুর একসময় বললেন, ‘যে-কথাটা আমাকে সেদিন বলতে চেয়েছিলি, আজ বল।’
দোলনের শরীর তখন ধীরে ধীরে উষ্ণ হচ্ছিল। কণ্ঠস্বর জড়িয়ে আসছে। সেই অবস্থায় বলল, ‘কোন কথা?’
‘যা আমাকে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না।’
‘সে-কথা কি আর বলবার দরকার আছে?’
‘তুই-ই তো বলেছিস, বলবি?’
‘তুমি কি সে-কথা বুঝতে পারনি?’
‘পেরেছি।’
‘তাহলে?’
‘তারপরও তোর মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি।’
ঠাকুরের ডান পাশের বুকে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে দোলন বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
‘তা আমি জানি।’
‘সেদিন এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলাম।’
‘কেন এরকম ভালোবাসলি বল তো?’
‘এরকম মানে?’
‘তোকে আমি যখন এই বাড়িতে নিয়ে এলাম, তারপর থেকে যেভাবে তোর প্রতিপালন করলাম, তাতে এক ধরনের ভালোবাসা আমার প্রতি তোর তৈরি হওয়ার কথা। আমারও তৈরি হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। যত দূরসম্পর্কেরই হোক, তোর মা ছিল আমার বোন। তুই আমার ভাগ্নি …’
‘তা আমি জানি। তুমি আমার মামা।’
‘মামার সঙ্গে কি প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক হয়?’
‘সম্পর্কটা অস্বাভাবিক। কিন্তু হতে পারে। কৃষ্ণর তো মামির সঙ্গে প্রেম হয়েছিল। দূরসম্পর্কের হলেও রাধা তাঁর মামিই হতেন। তাহলে আমি তোমার ভাগ্নি হয়ে ভালো তোমাকে বাসতেই পারি। তোমার প্রেমে পড়তেই পারি। শুধু প্রেমে পড়াই না, তোমার জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। এক দুপুরে দেখেছিলাম, পুকুরঘাট থেকে স্নান করে এসে উঠোনের তারে ধুতি মেলে দিচ্ছ। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। তোমার পিঠটা চোখে পড়ল। কাঁচা হলুদের বর্ণ পিঠের। বেশ চওড়া। কোমরের দিকটা সরু। বিন্দু বিন্দু জল লেগেছিল তোমার ঘাড়ে পিঠে। ওই দেখে আমার শরীরের ভিতরে যে কী হলো, মনে হলো শরীরে আগুন ধরে গেছে। আমার বুক শক্ত হয়ে গেল। আমি ভিজে গেলাম। মনে হচ্ছিল তক্ষুনি ছুটে গিয়ে পিছন থেকে তোমাকে জড়িয়ে ধরি। তোমাকে টেনে নিয়ে যাই ঘরে। তারপর আঁচড়ে কামড়ে যা ইচ্ছে তা-ই করি। তারপরই ভেবেছি, ছি ছি, এ আমার কী নোংরা ভাবনা! তুমি তো আমার মামা। মামার সঙ্গে কি ওসব হয়? রাতের পর রাত তারপর আমি ঘুমাতে পারিনি। তোমার কথা ভেবে পাগল হয়েছি। প্রতি রাতেই ইচ্ছা করতো তোমার কাছে চলে যাই। অতিকষ্টে নিজেকে আটকে রাখতাম। তারপর ভাবলাম, তোমাকে বলে দেই। বলে দেই তোমাকে ছাড়া আমার উপায় নেই। তারপরও দেড়-দু মাস চেপে থেকেছি। ঝড়ের রাতে ভয় পেয়েছি ঠিকই, তোমার ঘরে এসে উঠেছি ঠিকই, সেই মুহূর্তে শুধু ঝড়ের ভয়ই ছিল না, ভয়ের সঙ্গে ছিল তোমার কাছে আসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আমার শরীরের ভিতরও সেদিন বইছিল প্রচণ্ড ঝড়। সারারাতের পর বাইরের ঝড় যেমন থেমেছিল, পাঁচবারের পর আমার শরীরের ঝড়ও থেমেছিল। ভালোবাসার সঙ্গে তীব্র কাম যুক্ত হলে এরকম হয়। তোমার ঘরের অনেক বই আমি পড়েছি। বই পড়ে এসব জেনেছি …’
দোলন পর্বের বহুকাল পর ঠাকুরের জীবনে ঘটবে বাসমত্মী কাণ্ড। নবীন রিসির মেয়ে বাসন্তীর ধর্ষণের শিকার হবেন তিনি। বাসন্তীও ছিল কামে জর্জরিত যুবতী। ঠাকুরের ওপর চড়াও হবে সে ভূতে ধরার উসিলায়। ধর্ষণকাণ্ডে পোয়াতি হবে। ভুতুর জন্ম দেবে। ঠাকুর তাকে পদ্মায় নিয়ে ডুবিয়ে মারবেন। ধর্ষণের শোধ নেবেন বাসন্তীকে হত্যা করে। সে তো এক হত্যাকাণ্ডই।
দোলনকেও হত্যা করেছিলেন দেবু ঠাকুর। এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল অন্যভাবে। সে-হত্যা আসলে হত্যা না করেও হত্যা।
… তখন ধীরে ধীরে উষ্ণ হচ্ছিলেন দেবু ঠাকুর। সেই ঝড়ের রাতেই তিনি অনুভব করেছিলেন দোলন এক অসামান্য কামুক যুবতী। নরম নিরীহ ছোটখাটো দেহের মেয়েটির ভিতর যেন ঘুমিয়েছিল ভয়ংকর এক আগ্নেয়গিরি। ঠাকুরের কাছে এসে যেন খুলে গেল আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। তীব্র উদ্গিরণ শুরু হলো।
ঠাকুরও কামুক পুরুষ। তিনিও ঝাঁপ দিলেন আগ্নেয়গিরিতে। আগুনে আগুন লেগে শরীরের নিয়মে একসময় তা জল হয়ে গেল।
এই আগুন-জলের খেলা চলছিল দু-বছর ধরে। সেই রাতে ঠাকুরকে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তুলছিল দোলন। আর এইসব কথা বলছিল।
ঠাকুর একসময় বললেন, ‘এভাবে দিন যাবে না। এর একটা পরিণতি আছে।’
দোলন গোঙানির স্বরে বলল, ‘এখন আর আমি কোনো কথা শুনবো না। আমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তুমি আমাকে শীতল করো।’
ঠাকুর তাঁর স্বভাব অনুযায়ী সময় নিয়ে শেষ করলেন সঙ্গমকাল। সেই ফাঁকে শীতল থেকে শীতলতর হয়েছে দোলন। প্রথমে বিপরীত আসনে ছিল সে। নিস্তেজ হওয়ার পর ঠাকুর তাকে বুকের তলায় এনেছেন। সেই অবস্থাতেই বলেছিলেন, ‘তোর ভিতর যে এত আগুন, আমি তা কল্পনাও করিনি।’
দোলন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আমি নিজেও জানতাম না। তোমাকে পাওয়ার পর আমি যেন আমার শরীর আবিষ্কার করেছি। তুমি ছাড়া এই শরীরের কোনো উপায় নেই।’
‘ভালোবাসলে শুধু শরীরের কথা ভাবতে হয় না। ‘কাম হতে প্রেমের উদয়, প্রেম হলে কাম থাকে না।’ মহাজনরা বলেছেন। এখনো আমার সঙ্গে প্রেম তোর হয়নি। এখন চলছে তোর কামপর্ব। প্রেম হলে এরকম করে কামার্ত তুই না-ও হতে পারিস।’
দোলন কোনো কথা বলল না।
ঠাকুর বললেন, ‘বিয়ের উপযুক্ত বয়স হয়েছে তোর। বড়জোর আর এক-দুবছর এভাবে থাকতে পারবি। তারপর আর কোনো উপায় নেই।’
‘বিয়ে আমি করতে চাই না। এভাবেই তোমার কাছে থেকে যেতে চাই।’
‘তা কি সম্ভব?’
‘অবশ্যই সম্ভব।’
‘কীভাবে?’
‘হিন্দু পরিবারের অনেক মেয়ে এভাবে জীবন কাটায়। চিরকুমারী থেকে যায়। আমিও তা-ই থাকবো।’
‘লোকে এই নিয়ে কথা বলবে। বলবে, যুবতী ভাগ্নিটিকে ইচ্ছা করেই বিয়ে দিচ্ছে না ঠাকুর। নিজের স্বার্থে বাড়িতে রেখে দিয়েছে।’
‘সেই জবাবও তোমার কাছে আছে।’
‘জবাবটা কী বল তো?’
‘বলবে, অনাথ মেয়ে। বাপ-মা কেউ নেই। কোনো পাত্রই এই মেয়েকে বিয়ে করতে চায় না।’
‘এটা খুব শক্ত যুক্তি না। আমার টাকাপয়সা আছে, চাইলেই টাকা খরচা করে পাত্র জোগাড় করতে পারি। এটা কোনো কঠিন কাজ না।’
দুজনেরই নগ্ন শরীর। ভাদ্র মাসের শেষ দিক। মধ্যরাতের দিকে একটু একটু শীতভাব হয়। আজো হয়েছে। দুজন মানুষের কেউ তা টের পাচ্ছে না।
দোলন জড়িয়ে ধরলো ঠাকুরের গলা। মুখটা তুলে দিলো তাঁর বুকে। বলল, ‘আমি এভাবে সারাজীবন তোমার কাছে থেকে যেতে চাই। এভাবে তোমার বুকে মুখ রেখে মরে যেতে চাই।’
‘মেয়েদের অনেক স্বপ্ন থাকে দোলন। স্বামী-সংসার-সন্তানের স্বপ্ন। আমার কাছে তুই তা পাবি না। সেটা সম্ভবও না। বরং দুজনেরই দুর্নাম হবে …’
‘স্বামী তো আমি পেয়েছিই। এই যে তুমি। আমার বাবা-মা, স্বামী-সন্তান, জীবন-মরণ, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সব তুমি। আমার আর কিছুই চাই না।’
ঠাকুর বুঝে গেলেন, এখনই এই মেয়েকে আর কোনো বুঝ দেওয়া যাবে না। শরীরের ঘোর কাটতে তার সময় লাগবে। লাগুক। পরে দেখা যাবে।
দু-বছরের মাথায়ই কথা রটতে লাগলো ঠাকুর আর দোলনকে নিয়ে। হয়তো রোগীরা কেউ কেউ রটালো। গ্রামের ছেলেমেয়েরাও রটাতে পারে। চৌধুরীর বাড়ির আনুর সঙ্গে দোলনের গভীর বন্ধুত্ব। সই পাতিয়েছে দুজনে। মেয়েরা মেয়েদের মনের কথা বুঝতে পারে দ্রুত। আনু হয়তো তার সইয়ের মনের অবস্থা ধরে ফেলেছে। পুরুষ সহবাস করা মেয়েদের শরীর দ্রুত বদলায়। যৌনতৃপ্তি অন্যরকম লাবণ্য এনে দেয় মুখে। সেই ঢলঢল মুখ দেখে আনু নিশ্চয় অনুমান করেছে ব্যাপারটা। প্রেম চেপে রাখা যায় না। প্রেমে পড়া মানুষের মুখ দেখলেই অন্যরা খুব সহজে তা বুঝে যায়।
দোলনের সই আনু বুঝেছিল।
চতুর প্রিয়নাথ বুঝেছিল।
চৌধুরীও বুঝেছিলেন।
কে কাকে কথায় কথায় নিজেদের অনুমানের কথা বলে ফেলেছিল। সঙ্গে বানিয়ে বলেছিল আরো কিছু মুখরোচক কথা। ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মীর বাড়ির আলতাফ মীর এই নিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে একদিন কথা বললেন। ‘ঠাকুর, দোলনরে বিবাহ দিতাছ না ক্যান? ভাগ্নির তো বিবাহের বয়স পার হইয়া যাইতাছে।’
ঠাকুর চমকালেন। প্রখর বুদ্ধিমান লোক। আলতাফের কথা বলার ধরনেই যা বোঝার বুঝে গেছেন। চোখ তুলে তার মুখের দিকে তাকালেন। ‘হঠাৎ দোলনের বিবাহের কথা বলতাছ? ঘটনা কী?’
‘না ঘটনা তেমন কিছু না। দূরসম্পর্কের উপযুক্ত ভাগ্নি, এইভাবে তোমার বাড়িতে থাকে! বয়স হইছে, তুমিও বিবাহ করতাছ না। মানুষ এইসব ভালো চোখে দেখে না। নানান পদের কথা হয় গেরামে। ভাগ্নির বিবাহ দিয়া দেও। বদনামের ভাগী হইয়ো না।’
আরেকদিন কথা বললেন রতনপুর হাই ইস্কুলের রাজ্জাক মাস্টার। ‘শোন দেবু, তোমারে আমরা খুবই পছন্দ করি। হিন্দু মনে কইরা খারাপ চোখে দেখি না। ওই যে মাইয়াটা তোমার বাড়িতে থাকে, তার বিবাহের ব্যবস্থা করো। বাড়িতে রাইখো না।’
রাজ্জাক মাস্টারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সোনাদিঘা থেকে রোগী দেখে ফেরার পথে। সেদিন হাফ ইস্কুল। মাস্টার ফিরছিলেন বাড়ির দিকে। ঠাকুরও ফিরছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো বলেছিলেন মাস্টার সাহেব। পিছনে অনেকটা দূরে ঠাকুরের ব্যাগ নিয়ে হেঁটে আসছিল প্রিয়নাথ। তাঁদের কথা সে শুনেছিল। মুচকি হেসেও ছিল।
তারপরই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন ঠাকুর। দোলনের পাত্র নয়, পাত্রী দেখবেন নিজের জন্য। তিনি বিয়ে করে ফেললে দোলনকে নিয়ে আর কোনো কথা উঠবে না। সংসারে স্ত্রী এলে দোলনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও হবে না।
ঠাকুরের এই সিদ্ধান্তটা ছিল ভুল। পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়েছিল।
ব্রজলালের আসা-যাওয়া দেখে দোলন ভেবেছিল তার বিয়ের জন্যই ঘটকের আগমন। ওই নিয়ে একদিন কথা তুললো। ‘বাড়িতে ঘটক আসছে প্রায়ই। ব্যাপার কী? তুমি কি আমাকে বিদায় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ?’
ঠাকুর গম্ভীর গলায় বললেন, ‘না। তোর জন্য ঘটক আসছে না। আসছে আমার জন্য। আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
শুনে দোলনের মনে হয়েছিল, প্রবল ভূমিকম্প হচ্ছে। পায়ের তলার মাটি থরথর করে কাঁপছে। ঠাকুরের ঘরটি যেন দুমড়ে-মুচড়ে পড়েছে তার ওপর। সে যেন চাপা পড়ে গেছে। না শ্বাস নিতে পারছে, না শ্বাস ফেলতে পারছে! যেন গভীর জলে ডুবে গেছে সে।
এক সময় দম ফিরে পেল দোলন। যেন ভুস করে ভেসে উঠলো জলতলা থেকে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘না না না না, তুমি বিয়ে করবে না। কিছুতেই না। আমি ছাড়া অন্য কেউ তোমার জীবনে আসবে না। আমি ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে তুমি এক বিছানায় শুতে পারবে না …’
ঠাকুর কথা বলছেন না। তাঁর মুখ গম্ভীর। চোয়াল শক্ত। তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাই করবেন। একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সেখান থেকে তিনি আর ফেরেন না। প্রেম ভালোবাসা আবেগ কোনো কিছুই তখন আর তাঁর থাকে না। সিদ্ধান্ত ঠিক রাখার জন্য কাউকে হত্যা করতে হলেও ঠাকুর করবেন।
দোলনের কথা তিনি শুনলেন। বললেন না কিছুই।
ঠাকুরকে আরও বেশি আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা প্রতি রাতেই নিজের সাধ্যমতো করে গেল দোলন। ঠাকুরও সমান তাল দিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলালেন না। কমলরানি তাঁর স্ত্রী হয়ে এলো। বুকে পাথর বেঁধে দোলন তাঁকে বরণও করলো। ঘটনা শুরু হলো তারপর। [চলবে]


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.