দ্বিতীয় পর্ব
তিন
সেই রাতে ঠাকুরবাড়ির দিকে একটা নিমপাখি ডাকছিল। কৃষ্ণপক্ষের রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার দেশ গ্রামে। আষাঢ় মাস। আকাশে মেঘের চলাচল ছিল ঠিকই, তবে বৃষ্টি ছিল না। হাওয়ায় ছিল কদমফুলের গন্ধ।
নিমপাখির সঙ্গে কুসংস্কার আছে প্রবল। পাখিটা কেউ কখনো চোখে দেখেনি। কোন পাখিটা যে নিমপাখি কেউ বলতে পারবে না। ডাকে রাতের বিভিন্ন প্রহরে। ডাকটা তিন-চারদিন বয়সী বিড়ালছানার ডাকের মতো। দেশগ্রামের প্রাজ্ঞ মুরব্বিজনেরা বলেন, এই পাখিটা অশুভ। যে-বাড়ির দুয়ারে মৃত্যু এসে দাঁড়ায় সেই বাড়িতে এই পাখি রাতের কোনো না কোনো প্রহরে এসে ডাক দিয়ে যাবে। পাখিটা নাকি মাটিতে নেমে, বাড়ির বাগান-উঠোনে নেমে মাটিতে একটার পর একটা ঠোকর দেয় আর ‘নিম নিম’ শব্দে ডাকে।
এই নিমের অর্থ ‘নেওয়া’। নিয়ে যাওয়া। যে-বাড়ির উঠোন-পালানে নিমপাখি নেমে মাটিতে ঠোকর দেবে আর ‘নিম নিম’ করে ডাকবে সেই বাড়ির কেউ না কেউ মারা যাবে। ওই মাটিতে ঠোকর দেওয়ার অর্থ হচ্ছে মাটির তলায় চলে যাওয়া। মাটির তলায় নিয়ে যাওয়া। নিমপাখি কাউকে না কাউকে নিতে আসে। সে-রাতে এসেছিল দুজনকে নিতে। দেবকুমার ঠাকুর ও বীরেন চৌধুরীকে। ডাকটা আশপাশের বাড়ির লোকজন অনেকেই নাকি শুনেছিল। বদরুও শুনেছে।
বর্ষাকালে এলাকার বাড়িগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। একেকটা বাড়ি একেকটা দ্বীপ। চলাচলের বাহন নৌকা। যাদের নৌকা নেই, তারা এবাড়ি-ওবাড়ি যায় সাঁতরে।
সেদিন দুপুরের পরপরই রোগী দেখে ফিরেছেন ঠাকুর। গিয়েছিলেন কান্দিপাড়া। বদরু নৌকা বাইছিল। ঠাকুরের নিজস্ব ছইঅলা নৌকা। ‘কেরায়া নৌকা’র অর্থ হচ্ছে ভাড়ার নৌকা। এলাকার ‘বেলদার’ সম্প্রদায় নৌকা ভাড়ার কাজ করে বর্ষাকালে। নিজের ছইঅলা সুন্দর নৌকা নিয়ে বউ-ঝিদের বাপের বাড়িতে ‘নাইয়র’ নেয়। লঞ্চঘাটে পৌঁছে দেয় যারা 888sport app গোয়ালন্দ যাবে। 888sport appর লঞ্চ ভরা বর্ষায় গোয়ালিমান্দ্রা পর্যন্ত আসে। ভোররাতে উঠে সেই লঞ্চ ধরতে হয়। বেলদার মাঝিরা আগের সন্ধ্যায় এসে যাত্রীর বাড়িতেই থাকে। খেয়েদেয়ে ঘুম দেয়। ভোররাতে উঠে যাত্রী নিয়ে যায়। ফেরার সময় 888sport app বা গোয়ালন্দ থেকে আসা যাত্রী নিয়ে ফেরে।
সব সময় 888sport appর লঞ্চ গোয়ালিমান্দ্রা পর্যন্ত আসে না। আসে শ্রীনগর ঘাটে। বেলদার মাঝি সেই ঘাটের উদ্দেশ্যেই রাত
থাকতে উঠে নৌকা ছাড়ে। সময়মতো যাত্রী পৌঁছে দেয়। তারপর 888sport app থেকে আসা লঞ্চের আশায় বসে থাকে। এদিককার যাত্রী পেলে তাদের নিয়ে ফেরে।
গোয়ালন্দের যাত্রী ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। লৌহজং তারপাশা ভাগ্যকূল এই তিন ঘাটে স্টিমার থামে। সেই স্টিমার আসে নারায়ণগঞ্জ থেকে। উত্তাল পদ্মা পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে যায়। সেখান থেকে ট্রেন ধরে কলকাতার যাত্রীরা শিয়ালদহ গিয়ে নামে। পাকিস্তান-ইন্ডিয়া হয়ে যাওয়ার পর বিক্রমপুর থেকে কলকাতা যাওয়া-আসার লোক আস্তে আস্তে কমছে।
বেলদারদের কেরায়া নৌকার কারণে এলাকার ছইঅলা নৌকা মানেই ‘কেরায়া নৌকা’। ঠাকুরের নৌকাটাও কেরায়া নৌকা। বদরু তার মাঝি। বেজায় তাকৎ বদরুর শরীরে। ডোরাকাটা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরনে। কখনো বা খালি গা। কালো ভুষো চওড়া বুকপিঠ, হাত দুটো বট-পাকুড়ের ডালার মতো। লগিতে খোঁচ দিয়ে বা বৈঠা বেয়ে ঠাকুরকে নিয়ে এই গ্রাম সেই গ্রামে যায়। ঠাকুর বসে থাকেন ছইয়ের তলায়। আকাশে মেঘ-রৌদ্রের খেলা। বাতাস আছে কি নেই বোঝা যায় না। নৌকা বাওয়ার তালে তালে বদরুর শক্তপোক্ত কালো শরীর বেয়ে বৃষ্টি ধারার মতো নামে ঘাম। ঠাকুরের ঢুলুনি আসে।
গ্রীষ্মকালে নৌকাটা ডোবানো থাকে পুবদিককার পুকুরে। আর ছইটা খুলে রেখে দেওয়া হয় জামতলার ছায়ায়। বদরুর বৈষয়িক হিসাব ভালো। নৌকাটা পানিতে ডুবিয়ে রাখতে গিয়েও সে গৃহস্থলোকের কোষানাও ডিঙ্গিনাওয়ের কায়দাটা ধরে। নৌকার প্রয়োজন শেষ হলে গৃহস্থলোক বাড়ির সামনের পুকুরে নৌকা ডুবিয়ে রাখে রোদের হাত থেকে নৌকাটা রক্ষা করার জন্য। ডুবিয়ে রাখা নৌকায় হিজলের শক্ত ঝাপড়ানো ডাল কেটে, নৌকার ডরা ভরে ডোবায়। ব্যাপারটাকে বলে ‘ঝাঁকা দেওয়া’। ওই ঝাঁকা হচ্ছে মাছেদের নিরাপদ আশ্রয়। পুকুরের মাছগুলো এসে ঝাঁকা আর পানিপচা হিজলপাতায় আরামসে বসবাস শুরু করে। দশদিন, পনেরো দিন পর গৃহস্থলোক সাবধানে সেই নৌকা তোলে। ঝাঁকা সরিয়ে মাছ ধরে। মাছ রাখার ‘ডুলা’ ভরে যায় কই শিং মাগুর নলা টাকি সরপুঁটি মেনি বা রয়না বা ভেদা মাছে। কখনো কখনো বোয়াল, শোল, গজার, চিতল, কালিবাউস, গরমা বা রুইও পড়ে নৌকায়। ফলি মাছ পড়ে বিস্তর।
বদরুও এই কাজটা শুরু করেছিল। দশদিন-পনেরোদিন পর, যেদিন একেবারেই আজার, বিশেষ করে শীতকালে, সেদিন ছোট দু-ভাই আর ভাগ্নে নবুকে নিয়ে পুকুর থেকে নাও তোলে। দু-তিন ডুলা মাছ ধরে ফেলে। ঠাকুর আর চদরি কত মাছ খাবেন? বাছা বাছা মাছগুলো রেখে দেন তাঁরা। বাকিগুলো হাজামরা নিয়ে যায়। জিয়ল মাছগুলো বড়ো একটা হাঁড়িতে জিইয়ে রাখে বদরু। বিশেষ করে বিঘত সমান কইগুলো। পাকা কই। পেটের দিকটা হলুদ। পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা করলে ঠাকুর খুব স্বাদ করে খান।
সেদিন দুপুরের পরপর রোগী দেখে ফিরেছেন ঠাকুর। সকালবেলা চান করে বেরিয়েছিলেন। উঠোনের দক্ষিণ দিকে বান্দরলাঠি গাছটার পুবদিকে চৌচালা ছবির মতো, নাকি শিশুদের খেলনা ঘরের মতো একটা ঘর। চারদিক খোলা। ঢেউটিনের চাল দেওয়া ঘরটার মেঝে মাটির। সকালবেলা চান করে ফেরার সময় বাড়ির নামার দিককার কদমগাছ থেকে কয়েকটা কদমফুল ছিঁড়ে ওই ঘরটার মেঝেতে রাখলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন এমন ভঙ্গিতে যেন ধ্যান করছেন। তেরো বচ্ছরে এই দৃশ্য কখনো দেখেনি বদরু বা চদরি। সেদিনই প্রথম।
এই ঘরটা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। ঘরটা কি পূজার ঘর? না, ঠাকুর পূজাচ্ছা করেন না। ওই ঘরটা আসলে কমলরানীর 888sport sign up bonusর উদ্দেশে। ঠিক ওই জায়গাটিতে গায়ে আগুন দিয়ে মরেছিল কমলরানী। ঠাকুরের স্ত্রী। ঠাকুর গিয়েছিলেন সীতারামপুরের তালুকদার বাড়িতে। সেই বাড়িতে ‘কৃষ্ণলীলা’র গান হচ্ছিল। আসরে বসেই খবর পেলেন, কমল গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছে। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল দোলন, ঠাকুরের দূরসম্পর্কের ভাগ্নি। মেয়েটিরও হাত পুড়ে গিয়েছিল কিন্তু কাজ হয়নি। ঠাকুর ছুটতে ছুটতে এসে দেখেন পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে কমল। দোলন তার মাথাটা কোলে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছে। নিজের পোড়া হাতের যন্ত্রণার কথা তার মনে নেই।
ওই ঘরের সামনে সেদিন কেন দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠাকুর? নামার দিককার কদমগাছটার হাতের নাগালে পাওয়া ডালটায় ফুল ফুটেছিল বিস্তর। বেশ কয়েকটা ছিঁড়ে, দু-হাতের অঞ্জলি ভরে নিয়ে এলেন। ঘরটার মেঝেতে রেখে ধ্যানী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। কেন সেদিনই এমন করলেন? তিনি কি জানতেন আজই তাঁর শেষদিন? বাড়ির উঠোনে এসে অপেক্ষা করছে যমদূত? তিনি কি কমলরানীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন? কমলের 888sport sign up bonusর কাছ থেকে বিদায় নিলেন? নাকি নিজের অপরাধ মোচনের জন্য কাজটা করলেন?
বদরু তাঁকে সারাদিনই কেমন মনমরা দেখেছিল। রোগীবাড়ি যাওয়ার সময় মনমরা, ফিরে এসে মনমরা। সেদিন আর বই পড়লেন না। ভাত খাওয়ার পর নিজের কামরায় ঢুকে বদরুকে বললেন, এক মগ চা বানিয়ে দিতে। বদরু ততদিনে অসাধারণ চা বানায়। ঘন দুধ চিনি দিয়ে সত্যি সত্যি দারুণ চা। চা খেতে খেতে কলের গান বাজাচ্ছিলেন ঠাকুর। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের একটা গানই চার-পাঁচবার শুনলেন। ‘জল ভরো কাঞ্চনকন্যা জলে দিয়া মন।’
কোন কাঞ্চনকন্যার কথা মনে করে গানটা তিনি শুনলেন? কুসুমপুরের বড়বাড়ির মেয়ে কিরণ কি সেই কাঞ্চনকন্যা? জীবনভর কত মেয়ের আনাগোনা। ঠাকুর তো সবার কথা মনেও রাখেননি। অনেকে আসছে, গেছে। মনের ভিতরটা সোনার আলোয় ভরে রেখে গেছে ওই একজন, কিরণ। আসলেই সে কাঞ্চনকন্যা। সোনার বরনি মেয়ে। মনটিও সোনায় মোড়া ছিল তার। কোথায় ভেসে গেল সেই মেয়ে?
কমলরানী আত্মহত্যা করেছিল দোলনের জন্য। সম্পর্কে ঠাকুরের ভাগ্নি। ছোটখাটো। স্নিগ্ধ সুন্দর মেয়েটি। শোনা যায় সেই ভাগ্নির সঙ্গেও নাকি সম্পর্ক হয়েছিল ঠাকুরের। কমলরানী তা জেনে গিয়েছিল। সেই দুঃখ-বেদনা সহ্য করতে পারেনি। আত্মহত্যা করে মর্মবেদনা জুড়িয়েছিল।
সেদিন কি কোনো কারণে ঠাকুর কমলরানীর কথা মনে করে অনুশোচনায় পড়েছিলেন? এজন্যই কি কদম ফুল 888sport sign up bonusঘরের মেঝেতে রেখে মানুষটিকে মনে করেছিলেন? দুপুরে তাঁর মনে পড়েছিল কিরণের কথা! ঠাকুর তার নাম দিয়েছিলেন ‘কাঞ্চনকন্যা’।
ওই গানের পর তিনি সেদিন শুনলেন জগন্ময় মিত্রের সেই গানটি। একটা রেকর্ডের দুই পিঠেই গানটি। দীর্ঘ গান। ‘তুমি আজ কতদূরে!’ জগন্ময় মিত্রের ভরাট কণ্ঠে ‘যত লিখে যাই তবু না ফুরায়, চিঠি তো হয় না শেষ, 888sport sign up bonusর পাতায় আজও বাজে তাই প্রথম দিনের রেশ।’
মৃত্যু এসে দুয়ারে দাঁড়ানো মানুষের অবচেতন মন কি কোনো না কোনোভাবে তা টের পায়? বুঝতে পারে না, অবচেতনেই বিষণ্ন হয় সে, আনমনা হয়।
ঠাকুরের কি সেদিন তাই হয়েছিল?
চদরির নিজের ঘরটা প্রায় ভেঙে পড়েছিল। সরস্বতীর মৃত্যুর পর সেই ঘর চদরি বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন দেশে থাকলে ঠাকুরের ডিসপেনসারি কামরার চৌকিতে ঘুমান। খুন হওয়ার কয়েকদিন আগে কালনা থেকে ফিরেছেন মানুষটা। মরণ তাঁকে অতদূর থেকে ডেকে আনলো রতনপুর গ্রামে।
বিকেলের দিকে ঠাকুরের কাছে কিছু রোগী আসে। আর আসে কিছু আড্ডাবাজ লোক। সেদিন রোগী এসেছিল দুজন। ঋষিপাড়ার একটা বাচ্চা মেয়ের বেদম জ্বর। তাকে কোলে করে ঠাকুরের ডিসপেনসারিতে এনেছে মেয়েটির মা-বাবা। ভাঙাচোরা কোষানাওয়ে বসেছিল পাড়ার পরোপকারী মদন। ঠাকুর আনমনা ভঙ্গিতে তাকে দেখে ওষুধ দিয়েছেন। মাগনাই দিয়েছেন। টাকা-পয়সা নেননি। আর এসেছিল শিমুলিয়ার একজন পেটরোগা লোক। বয়স্ক। নিয়ে এসেছিল তার দুই ছেলে। ওই লোক ঋষিদের মতো হতদরিদ্র না। তবু ঠাকুর টাকা-পয়সা নিলেন না। উদাস ভঙ্গিতে দেখলেন তাকে। আয়ুর্বেদীয় ওষুধ দিলেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে দু-চারটা কথা বলে বিদায় করলেন।
চদরি বাড়িতে থাকলে বদরু রান্নাবান্না করে না। চা-ও বানায় না। যদিও বদরুর হাতের চা-ই বেশি পছন্দ করেন ঠাকুর। সেই বিকেলে নিয়মটা ভাঙলেন তিনি। বদরুকে বললেন, ‘আমার চা তুই বানাইয়া দে বদরু। চদরিরটা চদরি বানাউক।’
চদরি সামনেই ছিলেন। কিছু একটা বলতে চাইলেন। হাত তুলে ঠাকুর তাঁকে থামালেন। ‘তোমারডা তুমি বানাইয়া খাও গিয়া। আমার চা বদরুই বানাউক।’
ঠাকুরের মুখের ওপর কথা বলার সাহস কম চদরির। হাজাম বাড়ির লোক কাজ করবে ব্রাহ্মণের বাড়িতে, রান্নাবান্নাও করবে, শোনার পর চদরি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। ঠাকুরের রান্নাঘরের লাগোয়া আরেকটা রান্নাচালা তুলে নিয়েছিলেন। ঠাকুরের মনমর্জি বোঝা দায়। কোনোদিন তাঁর সামনেই বদরুকে হয়তো বললেন, ‘বদরু, কইমাছ ভুনা কর। বেশি কইরা তেল পিঁয়াইজ দিবি। কাঁচামরিচ দিবি।’
চদরি তাই সাবধান। নিজেরটা নিজে করেন। বদরুকে দেখলেই মুখটা বিরক্তিতে ছেয়ে যায় তাঁর। বদরু অবশ্য সেসব পাত্তা দেয় না। সে হচ্ছে ঠাকুরের সহচর। চদরিকে পাত্তা দেওয়ার তার দরকার কী? চদরির সামনে সে তেমন যায়ও না। হঠাৎ রান্নাঘরে বা চালার সামনে মুখোমুখি পড়ে গেলে চদরি ফিসফিস করে। ‘তরে না কইছি, দূরে দূরে থাকবি!’
‘আমি দূরেই থাকি। আপনের সামনে আহি না।’
‘এই যে আইলি?’
‘দাদার কামে আইছি। তিনার কাম তো করতে হইব, নাকি?’
চদরিকে রাগাবার জন্য ইচ্ছা করেও কখনো কখনো তাঁর সামনে যায় বদরু। ইচ্ছা করেই কোনো জরুরি কাজের ভান করে। চদরির ফিসফিসানি শুরু হয়, আর বদরু মনে মনে হাসে। ‘মালাউনের পো’ বলে মনে মনে গালও দেয়।
সেদিন সন্ধ্যার পরপরই ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়েছিল বদরু। সামনের ঘরে একখান, ঠাকুরের থাকার কামরায় আরেকখান। ঠাকুর তখন সামনের কামরার হাতলঅলা চেয়ারে উদাস হয়ে বসে আছেন। বললেন, ‘তুই খাইয়া আয় গিয়া বদরু। আমি আইজ রাইত্রে ভাত খামু না। খালি এক গেলাস দুধ খামু। ঐডা চদরি গরম কইরা দিব নে। তুই যা।’
ঠাকুরের নৌকা নিয়ে বাড়িতে গিয়েছিল বদরু।
বদরুর বাপ জমসেদ হাজাম অথর্ব হয়ে গেছে। ঘরের ছেমায় বসে থাকলে তাকে মরা ছিটকি ঝোপের মতো দেখায়। ছোট মেয়ে পাখি ধরে ধরে ঘর থেকে বের করে। সে ব্যস্ত থাকলে বড় ছেলে মজলিসের বউ হাফেজা শ্বশুরের সেবাটা করে। জমসেদের তুলনায় তার ছেলেমেয়ের মা এখনো বেশ শক্তপোক্ত। সেও স্বামীর কাজ যতটা পারে করে। বিশেষ করে
পেশাব-পায়খানা করানোর কাজটা তাকেই করতে হয়। বয়সী মানুষের মলের গন্ধ বীভৎস। নাকে আঁচল চেপে স্বামীর কাজ সারায় সে ঠিকই, তবে গালাগালের চূড়ান্ত করে তখন। ‘বুইড়ার পো বুইড়ায় আমার জানডা খাইয়া হালাইলো। মরণ অরে চোক্কে দেহে না? গোলামের পো গোলামে মরে না ক্যা?’
স্ত্রীর গালাগাল শুনেও মরে না জমসেদ। বউ-ঝিদের অবহেলা, ছেলেদের কালোমুখ সব দেখেও মরতে ইচ্ছা করে না তার। সে মরলে সংসারে একটা খাওয়ার মুখ কমে। এতগুলো ছেলেমেয়ে জন্ম দিয়েছে সে। একসময়কার জাঁদরেল হাজাম। শীতের দিনে খৎনার কাজের অভাব ছিল না। কাজের পর কাজ, কাজের পর কাজ। ‘হাটবাড়ি’ অর্থাৎ যে বাড়ি প্রায় হাটের মতন, ঘরের লাগোয়া ঘর, এক বাড়িতেই হয়তো তিরিশ-চল্লিশখান ঘর, সেই রকম বাড়িতে একদিনে সাত-আটটা ছেলের মুসলমানি অর্থাৎ খৎনা করিয়েছে। কোচড় ভরা টাকাটা আধলিটা সিকিটা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। পাঁচটা ছেলে আর চারটা মেয়ে জন্ম দিয়েছে। তাদের তিন ওক্তের খাবার দিতে অসুবিধা হয়নি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বড় ছেলে মজলিস ধরল বাপের কাজ। অন্যদিকে শিখলো লেপ-তোষক আর বালিশ বানাবার কাজ। শীতের দিনে করে হাজামি আর লেপ-তোষকের কাজ। গরমের দিনে গিরস্তের ক্ষেতখোলার কাজ। দিনমজুর। নিজেদের জমিজিরাত নেই। থাকার মধ্যে দশ-বারো গণ্ডার বাড়িটা। বাড়িতে একটা বড়ঘর। বড় ছেলের বিয়ে উপলক্ষে আরেকটা দোচালা টিনের ছোটঘর করেছিল জমসেদ। বছর ঘুরতে না ঘুরতে বউটা পোয়াতি।
মেজো ছেলে কুদ্দুস লঞ্চে খালাসির কাজ করে। ছয় মাস নয় মাসে একবার বাড়ি আসে। তবে মনিঅর্ডার করে প্রতিমাসে দশটা করে টাকা পাঠায় বাড়িতে। তার পরের ছেলে বদরু। সেও মাহিনার পনেরো টাকা থেকে দশটা-বারোটা টাকা বাড়িতে খরচা করে। হাজামতির কাজটা সে শিখে নাই। তার দেখাদেখি ছোট দুজন আজগর আর নুরুদ্দিনও বাপের পথ ধরেনি। পাঠশালায় এ-বাড়ির কেউ কখনো যায়নি। দশ-এগারো বচ্ছর বয়স থেকেই গ্রামের সচ্ছল গৃহস্থ বাড়িতে ফুটফরমাসের কাজ করে। তবে এই বাড়ির ছেলেমেয়েদের শরীর আর মনভরা আনন্দ-ফূর্তি। খাক না খাক আমোদ-ফূর্তির আকাল নেই তাদের। গলা খুলে গান গায়, গল্প-গুজব ঠাট্টা-মশকরা করে, মানুষকে বিমোহিত করতে তাদের জুড়ি নেই।
জমসেদ হাজামের চার মেয়ের দুজনের বিয়ে হয়েছে। বড় মেয়ে হালিমার শ্বশুরবাড়ি রানাদিয়া। নিজেদের জাত বংশেই বিয়ে হয়েছে। রানাদিয়ায় এই বংশের লোকজন আছে বিস্তর। তার পরের মেয়ে ফুলজান। তার স্বামী ঘরজামাই। এই বাড়িতেই একটা ঘর তুলে থাকে। প্রতিবন্ধী ধরনের মানুষ। বিচিত্র একটা কাজ করে সে। আবাল গরুর অণ্ডকোষ ফেলে ষাঁড় করে। পাঁঠার ওই জিনিস ফেলে খাসি করে। কাজটাকে গ্রাম এলাকায় বলা হয় গরু পাঁঠা ‘তোলানো’র কাজ। লোকটার নাম কফিল।
এই কাজে আর রোজগার কতটুকু? ফুলজান কাজ করে গৃহস্থবাড়িতে। ধান ভানা, ধান সিদ্ধ করা, বাড়ির 888sport app কাজ। বড় ছেলেটার নাম নবু। বারো-তেরো বছর বয়সেই সে ক্ষেতখোলায় কাজ করে। ইটামুগুর দিয়ে খরালিকালের চাষ করা জমির রোদে শুকিয়ে ইটের মতো শক্ত হয়ে যাওয়া মাটির ডেলা ভেঙে নিপাট করে। ছোট ছেলেটা কালু, পোড়া লাকড়ির মতো কালো। সে মাটিতে ‘হাপুড়’ অর্থাৎ হামাগুড়ি দেয় আর বাড়ি ফিরে ফুলজান তাকে কোলে নিলেই মায়ের বুকের দুধ খোঁজে।
জমসেদ হাজামের সেজো মেয়েটার নাম ছমিরন। সে একটু পাগলা কিসিমের। বিয়ের বয়স হয়েছে কিন্তু এই পাগলিকে কে বিবাহ করবে? পাড়া-বেড়ানো ছাড়া ছমিরনের কোনো কাজ নেই। বাড়ি ফিরে সময়মতো খাবার না পেলে ‘মুইরা পিছা’ অর্থাৎ উঠান পালান ঝাঁট দেওয়ার ঝাড়ু নিয়ে মাকে তাড়া করে। সঙ্গে তুবড়ির মতো গালাগাল। ‘ওই খানকির ঘরের খানকি, চোদানি মাগি, ভাত দেচ না ক্যা?’
ছোট মেয়েটা কিশোরী। নাম পাখি। নামের মতনই স্বভাব। সারাক্ষণ পাখির মতন ফুরুৎ ফুরুৎ করছে। এই আছে, এই নেই।
তবে হাজামবাড়ির মেয়েদের কোনো দুর্নাম নেই দেশগ্রামে। স্বভাব-চরিত্র ভালো তাদের। হাসি-মজায়, আনন্দে মেতে থাকে দিনরাত, বদস্বভাব কারোই নেই। ঠাট্টা-মশকরার ছলেও তাদের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। দিলে তার বারোটা বাজিয়ে ফেলবে। বাড়ির মুরব্বির কাছে বিচার দেবে সঙ্গে সঙ্গে। তারা বিচার না করলে গ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বারের কাছে যাবে। মাতব্বরদের কাছে যাবে। হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না।
সন্ধ্যার অনেকটা পর পর্যন্ত জমসেদকে ঘরের ছেমায় বসিয়ে রাখা হয়। সন্ধ্যার পর ঝাঁক বেঁধে মশা বেরোয় রোয়াইলতলার ওদিককার ঝোপ থেকে। চারদিককার বর্ষায় ডোবা ক্ষেতখোলা পুকুর থেকে। বেদম কামড়ান কামড়ায় জমসেদকে। মশারাও তাকে মানুষ মনে করে না। কোনো অবোলা জীব মনে করে বুড়ো শরীরের রক্ত যতটা পারে টেনে নেয়। অথর্ব হাত-পা নাড়িয়ে মশা তাড়ানোর চেষ্টা করে জমসেদ হাজাম। দু-চারটা মারাও পড়ে তার হাত-পা নাড়ার ফলে। তাতে মশাদের কিছু যায়-আসে না। রক্ত পান করা অবস্থায় মরে যেতেও তাদের আনন্দ। কিন্তু জমসেদের তো কষ্ট যন্ত্রণার শেষ নেই! তবু বেঁচে থাকতে ভালো লাগে মানুষটার। দৃষ্টি গেছে পদ্মার পানির মতন ঘোলা হয়ে। কোনো কিছুই পরিষ্কার দেখতে পায় না জমসেদ। কান প্রায় বয়রা। অনেক কথাই শুনতে পায় না, শব্দ শুনতে পায় না। শুধু ঘ্রাণশক্তি কিছুটা আছে, মুখে স্বাদ কিছুটা আছে। খেতে ভালো লাগে। যা দেয় গরিব সংসারের মানুষগুলো তাই ভারি স্বাদ করে খায় জমসেদ। পোলাপানের মায়ের গালাগাল সারাক্ষণই চলছে। বয়রা হয়ে আসা কানে সেই শব্দ অল্পবিস্তর আসে। জমসেদ কিছু মনে করে না, গায়েও মাখে না। সে তার মতো মরা ছিটকি ঝোপ হয়ে বসে থাকে। ক্ষীণ হয়ে আসা দৃষ্টিশক্তি যখন অতীত দিনের দিকে ফেরে, 888sport sign up bonusর অনেক ভিতরে যখন যায় দৃষ্টি, তখন তা রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের মতো হয়ে ওঠে। কতদিনকার কত ঘটনা ভেসে ওঠে। কত সুখ-দুঃখের 888sport sign up bonus, আনন্দ-বেদনার ঘটনা চোখের ভিতর থেকে দেখতে থাকে মানুষটা। সেইসব দিনের 888sport sign up bonus ফেলে কেন সে মরে যাবে? কত বর্ষা বসন্ত গেছে জীবনের ওপর দিয়ে, শীত গ্রীষ্ম গেছে! সংসার বড় হয়েছে, দিন কেটে গেছে দিনের মতো। দশাসই শক্তিশালী শরীর দিনে দিনে ক্ষয়ে গেছে। কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। এই তো দুনিয়ার নিয়ম। নিয়মটা মেনে নিয়েছে জমসেদ। তারপর একদিন মরণ। ওই একটা নিয়মই মানতে পারে না সে। কেন মরণ আসবে? কেন এই সুখ-দুঃখ ভরা, রোগ শোক কষ্ট বেদনা ভরা জীবনটা চলে যাবে? যত ব্যথা-বেদনা থাকুক, আহার-অনাহার থাকুক, অবহেলা-অপমান থাকুক তার পরও তো বেঁচে থাকা কত আনন্দের! এই যে ঘরের ছেমায়, প্রায় উলঙ্গ মানুষটা মরা ছিটকি ঝোপ হয়ে মাটিতে বসে থাকে, এই বসে থাকাটাই কী কম আনন্দের? শুধু দু-মুঠো খেতে পেলেই তো হলো! না হয় এক-দু বেলা তাও জুটল না, তাতে বা কী? বেঁচে তো থাকা যাচ্ছে! চোখ না হয় পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেল, কান না হয় গেল পুরোপুরি বয়রা হয়ে, ঘ্রাণশক্তি না
থাকুক, মাটির দলা খাচ্ছে না ভাত মিষ্টিআলু সিদ্ধ খাচ্ছে, আটার রুটি খাচ্ছে না মুড়ি খাচ্ছে, তাতে কি? একটু কিছু হলেই তো হলো। পেটটা ভরলেই তো হলো। বেঁচে তো থাকতে পারছে!
অন্ধ চোখের ভিতর লুকিয়ে আছে আলো ঝলমলে ফেলে আসা দিনগুলো। জোসনায় ভেসে যাওয়া বা গভীর অন্ধকারে ডুবে থাকা রাতগুলো। কত প্রিয় মুখ। সন্তানদের আনাগোনা। ভাইবোন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব। কত মানুষের মুখ আর 888sport sign up bonus। ওই নিয়েই তো কেটে যাবে শত শত বছর। তা হলে কেন মরণ?
এই কানে লেগে আছে কত আনন্দের সংবাদ। কত মিষ্টি আর তেতো কথা। কত পাখির গান। বয়রা হয়ে আসা কান পুরো বয়রা হলেই বা কী! ফেলে আসা দিনের ওইসব শব্দ নিয়েই তো বেঁচে থাকবে কান শত শত বছর। তাহলে কেন মরণ?
কত ফুল ফুটেছে একদা এই পৃথিবীতে। কত রকমের সৌরভ তাদের। জন্মের পর কোলে নেওয়া সন্তানের শরীরের ঘ্রাণ, অতিস্বাদের খাবারের গন্ধ, কত কত সৌরভ অথবা ঘ্রাণ অথবা গন্ধে ভরে আছে নাসারন্ধ্রের পুরোটা। সেইসব নিয়েই তো কাটিয়ে দেওয়া যায় শত বছর। তা হলে কেন মরণ? স্ত্রী-সঙ্গমের আনন্দ, সন্তান জন্মের আনন্দ, জগৎসংসার ভরে আছে আনন্দে আনন্দে, তা হলে কেন মরণ? বিষাদ বেদনার গভীরেও তো আছে অন্য এক প্রকারের আনন্দ। খুঁজে নিতে হয় সেই আনন্দ। ‘জগৎ আনন্দময়, যায় মনে যা লয়।’ তা হলে কেন মরণ? জমসেদ এই আনন্দের ভিতর বেঁচে আছে। 888sport sign up bonusর ভিতর বেঁচে থাকার উৎস খুঁজছে। সংসারের অনাদর অবহেলা, লাত্থি-গুঁতা, অপমান কোনো কিছুই তার গায়ে লাগে না। শুকনো ছিটকি ঝোপ হোক আর যাই হোক, বেঁচে যে আছে এই তার আনন্দ।
একদা সুখ আনন্দের কমতি ছিল না সংসারে। ভাই বেরাদর আত্মীয় স্বজন সব রয়ে গিয়েছিল রানাদিয়া গ্রামে। জমসেদ ভাগ্যবদলের আশায় একা চলে এসেছিল রতনপুরে। এই গ্রামে হাজামতি করার লোক নেই। মুসলমানেরা জায়গা দিয়েছিল থাকার। হিন্দুপ্রধান এলাকা। দেশভাগের বহু আগের ঘটনা। জমসেদ এই গ্রামে এসে জেনেছিল আশপাশের দশ গ্রামেও হাজাম নেই। দশ গ্রামেই তার কদর হয়েছিল। বিয়ে করে আনল রানাদিয়ার কন্যা মাজেদাকে। সন্তানের পর সন্তান এলো সংসারে। কত সুখের দিন সেসব।
খৎনার কাজ হয় সাধারণত দুপুরের পরপর। বিকেলের মুখে মুখে। দুপুরের ভাত খেয়ে কাজে চলে গেছে জমসেদ। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা বা রাত। স্ত্রী জেগে বসে থেকেছে, পোলাপান বাবার ফিরে আসার অপেক্ষায় থেকেছে। অপেক্ষায় থাকার আরেকটা কারণ হলো, যত গরিব মানুষের বাড়িতেই খৎনার কাজটা হোক না কেন, ফেরার সময় সেই বাড়ি থেকে টাকা-পয়সার সঙ্গে গুড়মুড়ি নয়তো নাড়ুমোয়া খেতে দেয় গৃহস্থলোক। অবস্থাপন্নরা দেয় রসগোল্লা বালুসা লালমোহন আমৃত্তি। জমসেদ ওসব পোলাপানের জন্য গামছায় বেঁধে নিয়ে আসতো। কত মজা করে সেই সব খেত পোলাপানে। বাপের বিরাট কদর তাদের কাছে। দিনে দিনে দিন গেল। সকাল হলো দুপুর, দুপুর হলো বিকেল, বিকেল হলো সন্ধ্যা, সন্ধ্যা হলো রাত। জমসেদের জীবনে নেমে এলো ঘোরতর অন্ধকার। স্ত্রীর মায়ামমতা শেষ হয়ে গেল, সন্তানদের ভালোবাসা শেষ হয়ে গেল। একদা এতবড় সংসারের পুরো বোঝাটা ছিল যার কাঁধে। এত এত বছর বোঝাটা টেনে গেছে সে। সংসারের কারো গায়ে আঁচড়টা লাগতে দেয়নি। সেই মানুষই হয়ে গেল সকলের বোঝা। জীবন বড় নিষ্ঠুর। ভালোবাসার রং বর্ষাদিনের আকাশের মতো। এই একটু ফরসা, এই ঘোরতর অন্ধকার। এই মেঘ, এই বৃষ্টি। অভাব কেড়ে নেয় সব আনন্দ। নিজে সামান্য ভালো থাকার জন্য একদার প্রিয় মানুষটিকে ছুড়ে ফেলে দেয় সংসারের অন্য মানুষ। পাখির ছানাদের মতো। দুর্বল অসহায় ছানাটিকে অন্য ছানারা, অথবা মা পাখি বাবা পাখি নিজেরাই ঠুকরে ঠুকরে মেরে ফেলে অথবা বাসা থেকে ফেলে দেয়। জমসেদের জীবন এখন তেমন। সংসারের বাসা থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে তাকে। বাড়ির আঙিনার বাইরে ফেলে দিতে পারেনি বলে, সমাজের নিয়ম, জ্যান্ত মানুষকে চকে মাঠে ফেলে দেওয়া যায় না, বাড়িঘরেই রাখতে হয়। সেই রাখাটা জমসেদকে রেখেছে সংসার ঠিকই, কিন্তু ঠোকর সে উঠতে-বসতে খাচ্ছে। বাড়ির ভাঙাচোরা অপ্রয়োজনীয় আসবাব হয়ে গেছে সে। তবু তার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। তবু তার মরতে ইচ্ছে করে না। যদিও একদার প্রিয় স্ত্রী তার মরণ চায় উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে। ছেলেমেয়েরা চায়। শুধু একজন, সংসারের একজন মাত্র মানুষের টান ভালোবাসাটা এখনো আছে জমসেদের জন্য। সেই মানুষটা বদরু। সেজো ছেলে বদরু হাজাম। বাপটাকে এখনো সে ভালোবাসে। বাপের জন্য এখনো তার টান। সেই টান প্রতিদিনই বোঝা যায়।
দুপুরবেলা যদি ক্বচিত কখনো রোগীবাড়িতে খেতে হয়, সেদিনের কথা ভিন্ন। অন্য দিনগুলোতে বদরু বাড়িতে ভাত খেতে আসে বিকেলের মুখে মুখে। যেদিন ঠাকুর রোগী দেখতে যান না সেদিন দুপুরেই বাড়িতে আসতে পারে। এসে একটু ধীরস্থিরভাবে বাপকে গোসল করায়। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরায় বা খালি গায়েই রাখে। মাথাটা কৎবেলের মতো হয়ে গেছে জমসেদের। ঘাড়ের কাছে, জুলপির সামান্য ওপরে কয়েক গাছি পাটের আঁশের মতো চুল বেশ লম্বা হয়েছে। সেই মাথার তালুু বরাবর এক খাবলা সরিষার তেল দিয়ে রাখে। তেলটা অনেক সময় জুলপির দুদিক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। মুখের দাড়িমোচ পাটের শুকনো আঁশের মতো। কোটরে বসা চোখের কোল চামড়ার ভাঁজে ভরে গেছে। কপালের অবস্থাও ওরকম। গলার চামড়া, শরীরের চামড়া এমন ঝোলা ঝুলেছে, আচমকা জোরে হাওয়া দিলে সেই চামড়া নদীর ঢেউয়ের মতো, কিংবা ধানিমাঠের ডাগর হয়ে ওঠা চাড়ার মতো দোল খাবে।
জমসেদ হাজাম এখন সত্যি সত্যি মরা ছিটকি ঝোপ। মরা না, শুকিয়ে লাকড়ি খড়ি হয়ে যাওয়া ছিটকি ঝোপ। শিকড়-বাকড় মাটির ভিতরে গেঁথে আছে বলে, সেই শিকড় তুলে যে হুড়মুড়িয়ে পড়বে তা আর হচ্ছে না।
এই নিয়েই সংসারে অশান্তি। কবে যে মরবে হাজাম? কবে যে বাড়ির লোকের জান জুড়াবে? সেই অপেক্ষায় আছে একদার পিরিতের স্ত্রী, আদরের পোলাপান, বদরু বাদে সবাই। বড়পোলার বউটা তো কিছুতেই সহ্য করতে পারে না মানুষটাকে। ঘর থেকে যদি জমসেদকে একটু বের করার কাজ পড়ে, যদি তাকে একটু খাইয়ে দেওয়ার কাজ পড়ে, এমন ফিসফিসানি শুরু করে সে, যেন দুনিয়াতে এরচেয়ে খারাপ কাজ আর কিছু নেই। কখনো কখনো মুখেও দু-চারটা এমন কথা বলে, বয়রা হয়ে আসা কানে আবছামতন সেইসব কথার টুকরো-টাকরা কানে যায় জমসেদের। সে কোনো কথা বলে না, কিছু মনে করে না। যেন কান পুরোপুরি বয়রা হয়ে গেলে সে খুশি হতো। চোখ পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেলে সে খুশি হতো। তার পরও সে বেঁচে থাকতে চায়। ছেলের বউয়ের গঞ্জনা খুব লজ্জার। সেই লজ্জা জমসেদ গায়ে মাখে না। তার কান ভরে থাকে পিছনে ফেলে আসা জীবনের মধুর সব সংলাপে। সংগমের প্রস্তুতি নেওয়ার আগে যৌবনবতী স্ত্রীর রংঢং আর রসের কথা, ভালোবাসার কথায় তার কান ভরে আছে। চোখ ভরে আছে কালোকোলো স্ত্রীটির সৌন্দর্যে, সন্তানদের মায়াবী মুখের সৌন্দর্যে, এই নিয়েই তো তার দিন রাত্রি কাটছে! মরবে কেন সে? এখনকার এই প্রতিদিনকার বাস্তব ঘটনাবলি নিয়ে ভাববে কেন?
একদিন হাফেজা সকালবেলা জমসেদকে বউয়া খাওয়াবার সময় প্রথমে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল কাছেপিঠে কেউ আছে কি না। যখন দেখল কেউ নেই, সকালবেলার মনোহর বউয়া খাওয়া নিয়ে সবাই ব্যস্ত, সেই ফাঁকে এক লোকমা বউয়া এমন করে জমসেদের মুখে ঠেলে দিলো, অতবড় একদলা বউয়া গলায় আটকে মানুষটা যেন এখনই কাৎ হয়ে পড়ে। দম নিতে না পেরে কাৎ হয়েই পড়ে থাকে মাটিতে, আর যেন না ওঠে। দু-তিনবারই কাজটা সে করল কিন্তু জমসেদ কোনো প্রতিবাদ করল না, শব্দ করল না, কাউকে ডাকল না। কথা সে বলতে পারে। মুখে দাঁত দু-চারটা আছে। পুরোপুরি ফোকলা হয়নি। কথা জড়িয়ে যায় সামান্য, তবে বোঝা যায়। বউর ঠেসে দেওয়া বউয়া অতিকষ্টে গিলে ফেলতে পারল সে প্রতিবারই।
হাফেজা দেখল, আরে কাজ তো হলো না! ‘বুইড়া’র তো হলো না কিছুই। তখন অতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে তিন-চারটা কঠিন ঠোকনা দিলো শ^শুরের নাকে-মুখে। কৎবেলের মতো মাথায় দিলো দুটো গাট্টা। আর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘এই খানকি মাগির পোলা, তুই মরচ না ক্যা? আল্লায় তর মরণ দেয় না ক্যা?’
আশ্চর্য ব্যাপার, হাফেজার খুব নিচুও না আবার খুব উঁচু গলায়ও না বলা কথাগুলো পরিষ্কার শুনল জমসেদ। সে কিছুই মনে করল না। একটি কথাও বলল না। মুখের গর্তে ঠেসে ঠেসে ভরা খাবারটাই বেশ মজা করে খেল। থালার বউয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় আবার চারদিকে একবার তাকাল হাফেজা। তারপর বাঁ পা দিয়ে মাঝারি মাপের একটা লাথি দিয়ে গেল শ^শুরের কোকসা বরাবর। ব্যথা যতটা না পেল তারচেয়ে শতগুণ বেশি অপমান বোধ করল জমসেদ। সত্যি সত্যি ছেলের বউর লাথি খেল সে? তার পরও চোখে পানি এলো না জমসেদের। বউয়ার মতো হজম করে ফেলল আদরের পুত্রবধূর লাথি। মারুক, আরো লাথি মারুক, তবু জমসেদ বেঁচে থাকতে চায়। কাঁদবে কেন? অভিযোগ করবে কেন? মেরে তো আর ফেলেনি হাফেজা? বেঁচে তো আছে জমসেদ!
সংসারে তার যা দুয়েকটা কথা হয় সেটা হয় বদরুর সঙ্গে। ওই একটাই জায়গা জমসেদের, বদরু। ইচ্ছা করলে সব কথা বদরুকে সে বলতে পারে। বদরু মন দিয়ে শুনবে বাজানের সব কথা, তারপর তাকে ধরবে যে তার বাজানের লগে খারাপ ব্যবহার করেছে, বাজানকে অবহেলা, অযত্ন করেছে। তুলকালাম করবে।
জমসেদ জানে, চব্বিশ ঘণ্টা তো আর বদরু তাকে পাহারা দিয়ে রাখবে না। দেখবে শুধু দুইবেলা বাড়িতে ভাত খেতে এসে। বাকি সময়টা তো তাকে থাকতে হবে এই মানুষগুলোর সঙ্গে। কী লাভ অভিযোগ করে? আর তার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না! বেঁচে তো আছে! বেঁচে থাকতে হলে মানুষের লাত্থিগুঁতা দু-চারটা খেতে হয়, অপমান-অপদস্থ হতে হয়। ওসব ধরে রেখে, অভিযোগ করে, সংসারে কাইজ্জাকিত্তন লাগিয়ে কী বেঁচে থাকা যায়? বেঁচে থাকাটাই তো বড় কথা! জমসেদ বেঁচে আছে তো, মরে যায়নি তো! দেউক না ছেলের বউ লাত্থি, কী হয় তাতে? ওই যে লাত্থি দিয়ে চলে গেল তার পরই তো সেই ঘটনা ভুলে গেছে জমসেদ। তার মন চলে গেছে ফেলে আসা দিনে, চোখ চলে গেছে মধুর 888sport sign up bonusতে। কানে বাজছে পাখিদের মিষ্টি গান, হাওয়ায় ভেসে আসছে বুনোফুলের গন্ধ। শরীরে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে ফুলগন্ধ ভরা হাওয়া। আহ্ বেঁচে থাকা কী আনন্দের!
তার পর আরেকটা লাথিতে কেলেংকারি হয়ে গেল সংসারে।
তখন মধ্যদুপুর। রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত মাজেদা। হাফেজা আর পাখি আছে তার পাশে। ছোট পোলা দুটো কোন বাড়িতে কাজে গেছে। পাগল মেয়েটা পাড়া বেড়াতে গেছে। জমসেদ অপেক্ষা করছে বদরুর। পোলাটা আইয়া গোসল করাইবো। গরমের দিন। গোসলের পর ভারি আরাম হয় শরীরের।
এসময় লুঙ্গি নষ্ট করে ফেলল জমসেদ। কখন যে কাজটা হয়ে গেল টেরই পেল না। লুঙ্গি মাখামাখি হয়ে গেল। বাড়িটা দুর্গন্ধে ভরে গেল। হাফেজা তার ঘরের দিকে যেতে যেতে যা বোঝার বুঝে গেল। চিৎকার করে দশগণ্ডা জমির ওপর হাজামবাড়িটা পুরো মাথায় তুলে ফেলল। ‘ইস, গোন্দে টিকন যায় না গো। হেয় হাইগা-মুইত্তা মাখাইয়া হালাইছে। ছি ছি ছি ছি ছি!’
শুনে পাখিকে রান্না দেখতে বলে মাজেদা ছুটে এলো রান্নাচালা থেকে। কিছুদূর এসেই নাকে ময়লা, ত্যানা ত্যানা হওয়া শাড়ির আঁচল চাপাল। তার পর তুবড়ির মতো ছুটল গালাগাল। ‘গোলামের পো গোলামে করছে কী? বাড়িডারে দেহি পাইখানা বানাইয়া হালাইছে! এত গু অর পেডে আহে কই থিকা?’
কাছাকাছি এসে বলল, ‘ওই চোদানি মাগির পোলা, আমারে ডাক দিতে পারলি না?’ বলেই ডান পা তুলে বেশ জোরে একটা লাথি দিলো স্বামীকে। হাফেজার লাথি সামলাতে পেরেছিল জমসেদ, মাজেদারটা পারল না। একপাশে কাৎ হয়ে পড়ল। আর তখনই বরইতলার ওদিক দিয়ে বাড়িতে এসে উঠল বদরু। দূর থেকেই কাণ্ডটা সে দেখতে পেল। নাকে আঁচলচাপা মা বেদম জোরে একটা লাথি মারল তার বাজানকে। বাজান গড়িয়ে পড়ল একপাশে। দেখেই পাগলের মতো ছুটে এলো বদরু। গুয়ের গন্ধটা সে পেল। সেই গন্ধ গায়ে না মেখে বলল, ‘এইডা তুমি কী করলা, মা? বাজানরে লাত্থি মারলা?’
জমসেদকে টেনে তুলল বদরু। বয়রা মানুষ সব সময়ই একটু জোরে কথা বলে। জমসেদ বলল, ‘দেউক বাজান। আমি দুক্কু পাই নাই।’
ছেলের কাছে ধরা পড়ে মাজেদা কাঁচুমাচু হয়ে গেল। তার পরও গলার তেজ বজায় রেখে বলল, ‘হাই¹া মুইত্তা বিনাশ করছে। আমারে ডাক দিতে পারল না?’
‘হের লেইগা তুমি লাত্থি দিবানি বাজান রে?’
‘তয় কী করুম? কত সইয্য হয় মাইনষের? এই গু-মুত অহন কে পরিষ্কার করব? আমি বইছি রানতে! তুই আইবি ভাত খাইতে!’
‘বেবাকই বুজলাম। এর লেইগা তুমি লাত্থি মারবানি?’
এবার খড়নাড়ার মতো জ্বলে উঠল মাজেদা। ‘মারছি ভালো করছি। গোলামের পোয় মরে না ক্যা? আমার জানডা খাইতাছে ক্যা? তর যহন বাপের লেইগা এত দরদ, তয় তুই তার গু সাফ কর না, দেহি আমি।’
বদরু দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আমিই করুম, দেহ তুমি। তয় আইজ এই বাড়ির বেবাকতেরে আমি কইয়া দিলাম, যুদি আইজকার পর আমার বাজানের শইল্লে কেঐ হাত দেয়, হেই হাত ভাইঙ্গা গোয়া দিয়া ভইরা দিমু।’
কথাটা বদরু হাফেজাকেও শোনাল। হাফেজা দাঁড়িয়ে ছিল তার ঘরের দুয়ারে। শুনল সবই। শুনে বদরু যাতে না দেখতে পায় সেইভাবে মুখে একটা অবজ্ঞার ভঙ্গি করল। ঠাকুরের বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সংসারের জন্য অনেক কিছু নিয়ে আসে বদরু। মাহিনা পেয়ে টাকা দেয় মাজেদার হাতে। তার আয়েই সংসারটা ভালো চলে। ফলে বদরুর কদর এই সংসারে সবচাইতে বেশি। কমবেশি ভয় তাকে সবাই পায়। বদরুর ওপর দিয়ে কথা বলার লোক নেই। না বড় ভাই, না অন্য কেউ। মেজো ভাইটা লঞ্চের কাজে। ছয় মাস নয় মাসে বাড়িতে আসে। টাকা যা পাঠায় তাতে হয় না কিছুই। তাও তিন মাস ধরে পাঠাচ্ছে না। টাকা নাকি জমাচ্ছে। বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। হাজাম বংশের মেয়ে দেখতে বলেছে। এবার এসে বিয়ে করবে। এই অবস্থায় বদরুই সংসারের ভরসা। তার ওপর দিয়ে কথা বলবে কে?
মাজেদা তার পর নাকে আঁচল চেপে স্বামীর নোংরা সাফ করার কাজে হাত লাগাতে চাইল। বদরু তাকে একটা ধমক দিলো। ‘খবরদার তুমি বাজানরে ধরবা না। তার কোনো কাম তোমার করন লাগবো না। আমি আমার বাজানের কাম করুম। তুমি সরো এহেন থিকা। আমার মিজাজ আর খারাপ কইরো না। যাও তুমি। যাও এহেন থিকা।’
মাজেদা কথা বলল না, চলেও গেল না। নাকে আঁচল চেপে দাঁড়িয়েই রইল।
গু-মুতে মাখামাখি জমসেদকে ওই অবস্থায়ই শিশুর মতো পাঁজা কোলে নিল বদরু। পুকুর পারে নিয়ে বসিয়ে রেখে এলো। এমন জায়গায় বসাল, যেন পানিতে না পড়ে যায় মানুষটা। তার পর ঘরের ছেমায় এসে, পুরনো কোদাল আর কিছু খড়নাড়া আনলো। খড়নাড়া একপাশে রেখে জমসেদের নোংরা করা জায়গার মাটিটা চেঁছে চেঁছে তুলে খড়নাড়ার মধ্যে রাখল। নোংরা হওয়া পুরো জায়গার মাটি ওভাবে তুলে খড়নাড়ায় প্যাঁচিয়ে পায়খানার ওদিকটায় ফেলে এলো। তার পর গেল পুকুরঘাটে। হাতে অর্ধেকটা বাংলা সাবান আর ধুন্দুলের ছোবড়া। জমসেদকে পুকুরে নামিয়ে বাংলা সাবান দিয়ে, ধুন্দুলের ছোবড়া দিয়ে ডলে ডলে, শরীর নোংরা করা শিশুকে যেভাবে ডলে ডলে সাফ-সুতরো করে মা, ঠিক সেইভাবে জমসেদকে সাফ করল। শরীরের সব গন্ধ দূর হলো বাজানের। তার পর ধোয়া লুঙ্গি পরিয়ে কোলে করে তাকে নিয়ে এলো উঠানে। আগের জায়গায় আর বসালো না তাকে। পাখিকে বলল, ‘ওই পাখি, এহেনে ইট্টু নাড়া বিছা তো! তার বাদে বাজানের ছপটা বিছা নাড়ার উপরে।’
পাখি সঙ্গে সঙ্গে কাজটা করল। বদরু তার বাজানকে ছপের ওপর বসিয়ে দিলো। নিজে গোসল করে এসে দেখে ভাত হয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। পাখিকে বলল, ‘বাজানের ভাত আন।’
পাখি দৌড়ে গেল। ভাত আর টাকি মাছের ঝোল নিয়ে এলো টিনের থালায় করে। অতিযত্নে ভাত-তরকারি মাখিয়ে জমসেদকে খাওয়াতে লাগল বদরু।
কয়েক লোকমা ভাত খেয়ে এক ঢোক পানি খেল জমসেদ। বদরুকে বলল, ‘তুই চেতিচ না বাজান। তর মারে বকিচ না। দোষ হের না। দোষ আমার। আমিই বেবাকতেরে জ্বালাইতাছি। তুই চেতিচ না।’
গভীর মমতায় বদরু শুধু বলল, ‘তুমি খাও বাজান। প্যাট ভইরা খাও।’ [চলবে]


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.