আট

ভুতো ও নিমাইয়ের কাহিনি

কোনো বাপ যে ছেলেকে এত ভালোবাসতে পারে, এত আদরযত্ন মায়া-মমতায় ভরিয়ে রাখতে পারে; তাও নিজের ঔরসজাত সন্তান নয়, স্ত্রীর অপকর্মের ফসল, নিমাই এক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মানুষ প্রকৃত অর্থে নিজেকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসে। নিমাইয়ের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। নিজের চেয়ে হাজার লক্ষগুণ বেশি ভালো সে ভুতোকে বাসে। ভুতোর জন্মের পর যে কদিন বাসন্তী বেঁচে ছিল আপন গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা সন্তানটির দিকে সে চোখ তুলেই তাকায়নি। তাকিয়েছে নিমাই। পৃথিবীর সবটুকু মায়া-মমতা নিয়ে শিশুটিকে সে দেখেছে। নিজে তার সব রকমের পরিচর্যা করেছে। ময়না মাসিকে ডেকে এনে ছেলেকে প্রথম কয়েক দিন দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে। তারপর নিজেই কাজটা শিখে একাধারে ভুতোর মা এবং বাবা হয়ে গেছে। ঘরে কিছু জমানো টাকা ছিল, এক বস্তা চাল ছিল, ওই দিয়ে সংসার চালাতে লাগল। ভুতোর দুধের পয়সাটা শুধু লাগে। ডাল আলু তরিতরকারি কিছু ঘরে থাকে। বড় দুখানা মিষ্টি কুমড়াও ছিল। ছেলেকে ময়না মাসির কোলে দিয়ে আধ ঘণ্টা এক ঘণ্টার জন্য বাড়ি থেকে বের হতো নিমাই। সেই ফাঁকে দৌড়ে গিয়ে শাকপাতা তুলে আনত আশপাশের জমি থেকে। ঘরের পাশে মাওয়ার বাজার। সেখানে গিয়ে দু-একটা মাছ কিনে আনত। একলা মানুষের সংসার নির্বিঘ্নে চলে যেত। নিজের রান্নাবান্না, জামাকাপড় ধোয়া আর চান করা ওইসব সময়ে সে ময়না মাসিকে দাওয়ায় বসিয়ে রেখে যেত। ভুতো থাকত ঘুমে। বাকি পুরোটা দিন-রাত ভুতোর পাশে ছায়ার মতো আছে নিমাই। ভুতোর জন্য পরপর তিন বছর নিজের জমিটুকু বর্গা দিয়েছিল। ছেলে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। বাবার কোলে-কাঁধে চড়ে খলখল করে হাসে। আধো আধো ভাষায় বাবা বলে ডাকে নিমাইকে। নিমাইয়ের মন-প্রাণ তাতে গভীর আনন্দে ভরে যায়। ভুতোর বাবা ডাকের চেয়ে আনন্দ আর ভালো লাগার কোনো কিছুই এই পৃথিবীতে নেই নিমাইয়ের। যখন-তখন ছেলেকে কোলে-কাঁধে নিচ্ছে। ছেলেকে চান করাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে। বাড়ির বাইরে গেলে ছেলেটাকে কোলে করে নিয়ে যায়। ভুতো খুব শক্তপোক্ত শিশু হয়েছে। দশ-এগারো মাসের মাথায় সে হাঁটতে শিখে গেছে, দৌড়াতে শিখে গেছে। ‘হাপুর পাড়া’ অর্থাৎ হামাগুড়ি দেওয়ার আগেই যেন হাঁটতে শিখে গেল ভুতো। মাজায় কাইতানের সঙ্গে পিতলের ছোট্ট একটা ঘণ্টি বেঁধে দিয়েছে নিমাই। ছেলে হাঁটাচলা করলে টুং টুং করে শব্দ হয়। সেই শব্দে বুকে যেন মাদল বাজে নিমাইয়ের। আনন্দে ছটফট করে ওঠে সে। যেন দুর্গাপূজার দিনগুলো ঘনিয়ে এসেছে। দুর্গামূর্তি বানানোর কারিগরেরা কাজে লেগেছে। ঢোল ডগর বাজতে শুরু করেছে রিশিপাড়ায়। আনন্দে মেতে গেছে পুরো পাড়া। নিমাইয়ের অনুভূতিটা সেই পর্যায়ের।

ভুতোও বাপের জন্য পাগল। বাপ ছাড়া কিছুই বোঝে না। বাপ ছাড়া জগতের কাউকে চিনতেই চায় না। দু-আড়াই বছর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে বাড়ির বাইরে যেতে লাগল সে। নিমাই ক্ষেতে কাজ করলে ক্ষেতের পাশে হিজলতলায় বসে থাকে ছেলেটি। বাপ জুতা সেলাইয়ের কাজে মাওয়ার বাজারে গেলে সেখানেও বাপের পাশে বসে থাকে। নিমাই হয়তো

এক-দু পয়সায় লজেন্স বা বিস্কুট কিনে দেয়। ভুতো কুট কুট করে সেসব খায়। বাবার কাজ খেয়াল করে। কখনো বা একা একা পুরো বাজারটা ঘুরে আসে। বাজারের লোকজন সবাই ভুতোকে চেনে। আড়ালে-আবডালে ‘বাসন্তীর জাউরা পোলা’ বলে আখ্যায়িত করে। বেশি দুষ্ট লোকেরা ভুতোকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলে। ওইটুকু ছেলে খেয়াল করে সবই। নিমাই শিখিয়ে দিয়েছে কারো সঙ্গে কথা না বলতে। শিশুদের কৌতূহল সীমাহীন। সেই কৌতূহল নিশ্চয়ই ভুতোরও আছে। কিন্তু বাবা নিষেধ করেছে। ওইটুকু ছেলে বাবার কথা পুরোপুরি মান্য করে চলে।

রাতের বেলা চৌকিতে শুয়ে বাপ-ছেলে টুকটাক কথা বলে। ভুতোর স্বভাব হয়েছে গল্প শোনার। নিমাই তাকে ছেলেবেলা  থেকে জেনে আসা গল্পগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে। কখনো কখনো বানিয়েও বলে। গরু বরকির ছাল ছাড়াবার কথাও বলে। প্রথম কবে এই কাজে নেমেছিল সেই দিনটির কথা বলে। ছাল ছাড়িয়ে আনার পর থকথকে মাংস নিয়ে মড়কখোলায় পড়ে থাকে মরা গরু বরকি। আকাশ মেঘের মতো অন্ধকার করে তখন নেমে আসে শকুনের দল। এমন হুড়াহুড়ি করে মরা

গরু-বরকি খায়, চোখের নিমিষে গরু-বরকির হাড়হাড্ডি ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকে না। দেশ গেরামের বেওয়ারিশ কুকুরগুলো ছুটে যায় মড়কখোলায়। তাদের সঙ্গে শকুন আর গৃধিনীর ঝগড়াঝাঁটি লেগে যায় – মারামারি লেগে যায়। তবে শকুন এমন এক ঘৃণিত পাখি, তাদের দু-একটাকে মেরে যে কুকুরেরা ঝাল মেটাবে কিংবা শকুনের মাংস খাবে তেমন কাণ্ড কখনো হয় না। দেশ গেরামে শেয়ালেরও অভাব নেই। তারাও তক্কে তক্কে থাকে মরা গরু-বরকির মাংস খাওয়ার জন্য। দলবাঁধা কুকুরের সামনে তারা আসে না। রাতের অন্ধকারে মড়কখোলায় ঢুকে হাড়গুলি চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।

এসব কথাই গল্পের মতো করে ছেলেকে বলে নিমাই। খরালিকালের ফাল্গুন মাসের শেষ দিক থেকেই বেজায় গরম পড়তে শুরু করে। রিশিপাড়া ঘনবসতির জায়গা। পদ্মার এত কাছে হওয়ার পরও দিনের বেলা হাওয়া তেমন পাওয়াই যায় না। পাড়ায় কলাগাছ ছাড়া তেমন কোনো গাছ নেই। বাঁশঝাড় আর তেঁতুলগাছটা আছে পূজামণ্ডপের ওইদিকটায়। রোদ ঠেকানোর ব্যবস্থা তেমনভাবে নেই। বেজায় গরম চলতে থাকে মাসের পর মাস। কার্তিকের দিকে গিয়ে একটু একটু শীত পড়ে। কখনো কখনো কালবৈশাখিতে কিছুটা শীতল হয় প্রকৃতি। বর্ষার বৃষ্টিতেও হয়। এই গরমের হাত থেকে দিন রাত ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা নিমাইয়ের। খেয়েদেয়ে দুপুরে ঘুমানোর পর ভাঙা তালপাখায় ছেলের পাশে শুয়ে সারাক্ষণই তাকে বাতাস করে নিমাই। রাতভর করে। ঘুমের মধ্যেও তার হাত চলতে থাকে। এই ছেলের একরত্তি কষ্ট নিমাই সহ্য করতে পারে না। গরমকালে কখনো কখনো ঘুমন্ত ছেলের বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে দেখে, গায়ে-গলায় হাত বুলিয়ে দেখে ছেলে ঘেমে গেছে কি না। ওরকম হলে বিছানায় উঠে বসে নিমাই। গামছা দিয়ে পরম মমতায় ছেলের ঘাম মুছিয়ে দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে থাকে। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে বাড়ির উঠোনে ছেলেকে ভিজতে দেয়। বৃষ্টি গায়ে মেখে কী আনন্দ তখন ভুতোর! নিজের ছোট্ট কোষা নাওয়ে করে এদিক-ওদিক বেড়াতে নিয়ে যায় ছেলেকে। আর শীতকালে পুরনো কাঁথার তলায় শুয়ে ভুতোকে সে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখে। ছেলেকে স্পর্শ করে যে আনন্দ এই আনন্দের কোনো তুলনা নিমাইয়ের জীবনে নেই।

প্রথম প্রথম রিশিপাড়ার লোকজন নিমাইয়ের এই আদেখলাপনা দেখে হাসাহাসি করত আর টিটকারি দিত। মুখরা 888sport promo codeরা খালঘাটে চান করতে গিয়ে হাসাহাসি করত আর বলত – ‘বাসন্তীর জাউরা পোলা লইয়া এত আদেখলাপনা নিমাইয়ের, নিজের পোলা হইলে না জানি কী করত।’ অন্য একজন হয়তো বলল, ‘কারবারটা আসলে বাসন্তী কার লগে করছিল হেইডা তো কেউ কইতে পারল না। ভূতে ধরলে মাইয়াগো প্যাট হয় জিন্দেগিতে এমন কথা হুনি নাই।’

বেশিরভাগ 888sport promo codeর মন থাকে সন্দেহে ভরা। ওরকম সন্দেহপ্রবণ কেউ কেউ ঠাকুরকে সন্দেহ করে। একজন একদিন বলেই ফেলল, ‘কারবারটা মনে হয় ঠাকুরেরই। তার তো স্বভাব খারাপ। মাইয়া মানুষ হাতের কাছে পাইলে ছাড়ে না। ভূত ছাড়ানের নামে কারবারটা ঠাকুরই ওইদিন কইরা গেছে।’

আরেকজন বলে, ‘না মনে হয়। ঠাকুরের কারবার হইলে জাউরা দেখতে ঠাকুরের লাহান হইত। ছেমড়া তো হইছে বাসন্তীর লাহান। ঠাকুর আর যা-ই করুক রিশিপাড়ার মাইয়াগো লগে ওই কারবার করব না। হে দেবতার লাহান সুন্দর মানুষ! আর বাসন্তী আছিল বদসুরতের। ওর লাহান মাইয়ার লগে ঠাকুরে ওই কারবার করব না। ঘটনা অন্য কোনোহানে ঘটাইছিল বাসন্তী।’

ঠাকুর প্রসঙ্গ এখানেই চাপা পড়ল। আলোচনা ঘুরে গেল বাসন্তীর নদীতে ডুবে মরার দিকে। সে যে আত্মহত্যা করেছে এতে কারো কোনো সন্দেহ নেই। কথা হলো আত্মহত্যাটা সে আগেই করেনি কেন? বিয়ের কয়েক দিন পর থেকেই যখন বমি শুরু হলো তার, লাজলজ্জা থাকলে তখনই তো আত্মহত্যা করার কথা। হয় তেঁতুলগাছের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেবে, না হয় পদ্মায় গিয়ে ডুবে মরবে। বাসন্তী তো সাঁতারও জানত খুব ভালো। সাঁতার জানা মানুষের ডুবে মরাও কঠিন। নিশ্চয় গলায় মাটির কলস বেঁধেছিল বাসন্তী। কিন্তু আগে না মরে ভুতোকে জন্ম দিয়ে মরল কেন? আট-নয়টা মাস নিমাইয়ের ঘরে বসে রিশিপাড়ার প্রত্যেক মানুষের যে নিন্দামন্দ সে শুনল ওসব শোনার দরকারটা ছিল কি?

সেন্টু রিশির বউ মালতী ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছিল। দু-একটা নভেল বই সে বানান করে করে পড়েছে। সামান্য পণ্ডিতি ভাব আছে বউটির। সে বলল, ‘888sport promo codeর মন বড় গাঙের লাহান। কেউ ‘ঠাই’ (থই) পায় না।’

তবে আরেকটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল বাসন্তীকে নিয়ে। এই রহস্যের কূল-কিনারাও কেউ পায়নি। নদীতে ডুবে মরা মানুষের লাশ সাধারণত কয়েক ঘণ্টা পরেই ভেসে ওঠে। কেউ না কেউ সে লাশের হদিস পায়। পদ্মায় মাছ ধরতে থাকা জেলেরা হয়তো দেখে। লঞ্চ-ইস্টিমারের যাত্রীরা হয়তো দেখে, কেরায়া নৌকার মাঝি দেখে, মালামাল নিয়ে এক বন্দর কিংবা গঞ্জ থেকে যেসব মালবাহী নৌকা দূর-দূরান্তে যায় তাদের চোখেও পড়ে। কিন্তু বাসন্তীর লাশের কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি। মেয়েটা ডুবল তো ডুবলই। হয়তো কলসের ভারে লাশ তার ভেসে উঠতে পারেনি। হয়তো তার পচে গলে যাওয়া মাংস অভুক্ত মাছেরা আর কচ্ছপ কাছিমে ঠুকরে ঠুকরে খেয়েছে। হয়তো বাসন্তীর কঙ্কাল এখন পদ্মার গভীরে। বালির স্তর পড়ে পড়ে একসময় মাটির তলায় চলে যাবে রিশিপাড়ার বাসন্তী। দিনে দিনে মানুষের 888sport sign up bonusর অতলে হারিয়ে যাবে। হারাবে না শুধু নিমাইয়ের মন থেকে। ভুতোই তাকে হারাতে দেবে না। ভুতোর দিকে তাকালে কিংবা ছেলেটিকে স্পর্শ করলে বাসন্তীকে স্পর্শ করা হবে। ছেলের শরীর থেকে আসবে বাসন্তীর শরীরের ঘ্রাণ। এই ভালো লাগার মুগ্ধতা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বেরোতে পারবে না নিমাই।

বাবার সঙ্গে চলাফেরা করতে করতে অল্প বয়সেই পেকে উঠেছে ভুতো। পাঁচ সাড়ে পাঁচ বছর বয়সের সময় এক রাতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। হঠাৎই বাবাকে প্রশ্ন করল, ‘জাউরা কারে কয় বাবা?’

ছেলের প্রশ্ন শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল নিমাই। তারপর নিজেকে সামলাল। এই প্রশ্ন ছেলে একদিন করবে এ-কথা সে জানত। ভয়ে ভয়ে ছিল কোনদিন প্রশ্নটা উঠবে। সে-রাতে ওঠার পর তার মনে পড়ল, জবাব একটা সে ভেবে রেখেছিল। সেই জবাবটাই সে ছেলেকে দিলো। ছেলের মাথায়-পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘এটা একটা গাইল বাবা। খারাপ মাইনসে এই গাইলটা দেয়। বড় হইলে তুমি বুঝবা।’

‘তয় আমি কি খারাপ মানুষ? এই গাইলটা মানুষে আমারে দ্যায় কেন?’

ছেলেকে আদরের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো নিমাই। বুকের কাছে তাকে চেপে ধরে গালে ঠোঁট বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি খারাপ ছেলে হইবা কেন? তুমি আমার সোনার ছেলে, আমার মানিক, আমার সাত রাজার ধন। তোমার মতো ছেলে আর একটাও নাই রিশিপাড়ায়। তুমি সব থেইকা ভালো ছেলে দেইখা মাইনসে তোমারে হিংসা কইরা এই গাইলটা দ্যায়। তুমি এই হগল গাইল শুনবা না; কেউরে কিছু কইবাও না। মাইনসে যা ইচ্ছা কউক।’

আরেকটু বড় হয়ে একদিন মায়ের কথা তুলল ভুতো। ‘আমার মা’র কী হইছিল বাবা?’

সেদিনটা ছিল বর্ষামুখর। শ্রাবণের ধারা ঝরছিল বেশ কয়েক দিন ধরে। ঘরের বাইরে যাওয়া মুশকিল। রিশিপাড়ার লাগোয়া খাল উপচে জল উঠে গেছে পাড়ায়। রিশিপাড়া চলে গেছে হাঁটুজলের তলায়। পাড়ায় অভাব-অনটন চলছে। অনেকেরই আয়-রোজগার নেই, কাজ নেই। ভুতোর জন্মের পর থেকে একটা ব্যাপারে নিমাই খুবই সচেতন। অভাব জিনিসটা ছেলেকে সে দেখাতে চায় না। যত কষ্ট করেই হোক ঘরে মাসখানেক খাওয়ার মতো চাল ডাল আলু পেঁয়াজ তার থাকে। ছেলেটা গুড়-মুড়ি খেতে পছন্দ করে। জের ভর্তি মুড়ি থাকে। খেজুরি গুড়ের বড় বড় চাকা থাকে। চাকাগুলো মুড়ির জেরের ভিতরই রেখে দেয় নিমাই। যাতে গরমে গলে না যায়। সকালে সাজিভর্তি মুড়ি আর অনেকখানি গুড় খায় ভুতো। নিমাইও খায় তার সঙ্গে। খাবারের অভাব নিমাইয়ের সংসারে নেই। সেই শ্রাবণধারার দিনে, দুপুরের দিকে আলগা চুলায় ঘরের ভেতর রান্না করতে বসেছে নিমাই। সেদিন সে খিচুড়ি রান্না করেছিল। পাশে বসে বাবার রান্না দেখছে ভুতো। হঠাৎ বলল, ‘আমার মা’র কী হইছিল বাবা? সে গাঙে ডুইবা মরছিল ক্যান?’

এই প্রশ্নও যে একদিন উঠবে নিমাই জানত। জবাবও একটা সে ভেবে রেখেছে। খিচুড়ি রান্নার ফাঁকে জবাবটা সে দিলো। ‘তোমার মা’র মাথায় গণ্ডগোল আছিল বাবা। মাঝে মাঝে মাথাটা খারাপ হইয়া যাইত তার। তেতইল গাছের ভূতে ধরনের পর থেইকা মাথাটা একেবারেই গেছিল। তুমি হওনের পর মাথা গেল আরো খারাপ হইয়া। পাগল হইয়া গেছিল। পুরা পাগল। পাগলরা জল পছন্দ করে। এর লেইগা তোমার মায় নিশি রাইতে ঘর থেইকা বাইর হইয়া গেছিল। বাইর হইয়া পদ্মায় গিয়া ডুবছে। আমি উদিস পাই নাই। উদিস পাইলে তারে বাঁচাইতে পারতাম।’ ভুতো আর কথা বলেনি।

ভুতোর উনিশ বছর বয়সে শেষ দুপুরে নিমাই একদিন মারা যাবে। একটানা সতেরো দিন টাইফয়েডে ভুগবে সে। কাতর হবে যারপরনাই। ভুতো জান পরান দিয়ে বাবার সেবাযত্ন করবে। দিঘলী বাজারের বড় ডাক্তার নন্দীবাবুর কাছে যাবে ঘটনা বুঝে আসতে। টাইফয়েডের মোক্ষম ওষুধ কুইনাইন দেবেন নন্দী ডাক্তার। তাতেও কাজ হবে না। ভুতো সময়মতো বাবাকে ওষুধ খাওয়াবে। দুধের সঙ্গে বার্লি আর সাগু মিশিয়ে চামচে করে করে খাওয়াবে। বিছানায় উঠে বসার আর ক্ষমতা থাকবে না নিমাইয়ের। তবে ছেলের সেবাযত্নে সে মুগ্ধ হবে। টাইফয়েডে ভুগতে ভুগতে বিছানার সঙ্গে মিশে যাবে নিমাই। কথা বলতে গেলে গলা দিয়ে পরিষ্কার আওয়াজ বেরোবে না। ফ্যাসফ্যাসে একরকম আওয়াজ বেরোবে।

এই অবস্থায় এক মধ্যরাতে চোখ খুলে নিমাই দেখবে তার বুকের কাছে বসে আছে ভুতো। যেন বাবাকে পাহারা দিচ্ছে। যমদূতকে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না এই ঘরে। কাঁথার তলা থেকে অতিকষ্টে নিমাই তার ডান হাতটা বের করবে। ছেলের হাত যে ধরতে চাইছে এটা ভুতো সঙ্গে সঙ্গে বুঝবে। দু-হাতে বাবার হাতটা সে জড়িয়ে ধরবে। গভীর আবেগের গলায় বলবে, ‘কিছু কইবা বাবা? কও। তোমার যা মন চায় কও।’

নিমাই হাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাস গলায় বলবে, ‘আমি তর লেইগা কিছু করতে পারি নাই বাবা। বাপটা তরে দিছিলাম, মা’টা তরে দিতে পারি নাই। তুই আমারে ক্ষেমা কইরা দিছ বাবা।’

কথা বলার ফাঁকে দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামবে নিমাইয়ের। ওই দেখে ভুতোও আকুল নয়নে কাঁদতে থাকবে। ‘এই হগল তুমি কী কও বাবা, আমার তো মা লাগে নাই, ভাইবোন লাগে নাই, জ্ঞাতিগুষ্টি আত্মীয়স্বজন কিচ্ছু লাগে নাই। আমার তো তুমি আছ। আমার বাবা ছাড়া আমার কিছু লাগে না। তুমি ভালো হইয়া যাইবা বাবা, ভালো হইয়া যাইবা।’

ভুতো যখন বাসন্তীর গর্ভে, রাতদুপুরে একদিন তার উঁচু হওয়া পেটের উপর ঝুঁকে যেভাবে মায়াময় হাত গর্ভবতী বাসন্তীর পেটে বুলিয়েছিল নিমাই আর তার চোখের জল টপটপ করে পড়েছিল বাসন্তীর উঁচু হওয়া পেটে, সেই রাতে তেমন একটা কাণ্ড ঘটবে। বাবার বুকে হাত বুলাতে বুলাতে কাঁদতে থাকবে ভুতো। তার চোখের জল টপটপ করে পড়বে নিমাইয়ের বুকে, পেটে। কারণ কোন ফাঁকে শরীর থেকে কাঁথা সরে যাবে নিমাইয়ের, নিমাইয়ের সাধ্য নেই তা বোঝার, ভুতোও খেয়াল করবে না।

আগের মতোই ফ্যাসফ্যাসে গলায় নিমাই বলবে, ‘কান্দিস না বাবা, কান্দিস না। মইরা আমি শান্তি পামু একটা কথা চিন্তা কইরা, আমার পোলায় আমারে বহুত মায়া করছে, বহুত সেবাযত্ন করছে। আমার ভাগ্য ভালো, আমি তোর লাহান পোলা পাইছিলাম। মরতে আমার কোনো দুঃখ নাই। দুঃখ খালি একটাই – দুনিয়াতে তর আছিলাম আমি, আমার আছিলি তুই। আমি মইরা গেলে তোর কেউ থাকব না। তয় আমার আশীর্বাদ থাকব তোর লগে। তোর অনেক নামডাক অইব। যে রিশিপাড়ার মানুষ তরে খারাপ গাইল দিত, তারা তোরে মাথায় তুইলা রাখব। আমি আশীর্বাদ করলাম তরে, আশীর্বাদ করলাম …’

তখনই প্রাণটা বেরিয়ে যাবে না নিমাইয়ের। চোখ বন্ধ হয়ে যাবে, জবান বন্ধ হয়ে যাবে। মরণটান ওঠার ফলে শীর্ণ বুক হাপরের মতো ওঠানামা করতে থাকবে। ভুতো বুঝে যাবে মরণজগতে পা বাড়িয়েছে তার বাবা। ভোর হতে না হতেই পাড়ার লোকজন এক-দুজন করে এসে নিমাইকে দেখে যাবে। গত রাত থেকে একঠায় বাবার পাশে বসে থাকবে ভুতো। তার চোখের জল ফুরাবেই না। দুপুরের পর বুকের ওঠানামা বন্ধ হবে নিমাইয়ের। খোলা দুয়ার দিয়ে এসে যম তাকে নিয়ে যাবে এক অলৌকিক জগতে।

গত রাত থেকে এই দুপুরের শেষ বেলা পর্যন্ত নিঃশব্দে কেঁদে চলবে ভুতো। বাবার দম চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল দেখে উঠোনের মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে বুকফাটা আর্তনাদ করতে থাকবে। ‘বাবা, বাবা গো, আমারে হালাইয়া তুমি কই চইলা গেলা? আমারে অহন কে আদর করব? কে বাবা বাবা বইলা প্যাঁচাইয়া ধরব? এই দুনিয়ায় তুমি ছাড়া আমি তো কেউরে বুঝি নাই! আমারে তুমি এমতে হালাইয়া গেলা? বাড়ি ফিরা আমি কারে বাবা বইলা ডাক দিমু। কে আমার লাইগা রাইত জাইগা বইয়া থাকব? কে আমারে কইব আইছ বাজান? এত কাম করণের কাম কী। যা হাত-মুখ ধুইয়া আইসা ভাত খাইতে বয়। আমারে মাথায় পিঠে হাত দিয়া কে আদর করব? বাবা ও বাবা …’

তিরিশ দিন অশৌচকাল পালন করবে ভুতো, তিরিশ দিনের দিন নিমাইয়ের শ্রাদ্ধের কাজটা সাধ্যমতো করবে। তারপর নিমাই যেভাবে একা একা সংসার গৃহস্থালি আর রিশি মুচির কাজটা করেছে সেইসব কাজই ভুতো করতে থাকবে। রিশিপাড়ায় আর দেশ গেরামের বাজারঘাটের কারো সাতে পাঁচে সে থাকবে না। নিজের কাজ ছাড়া, নিজের উন্নতি ছাড়া অন্য কিছুই ভাববে না।

সেবারের বর্ষাকালে ব্যাপক ভাঙন শুরু হবে পদ্মায়। পনেরো-কুড়ি দিনের মধ্যে মাওয়ার বাজার, তার পশ্চিমে জেলেপাড়া, বটগাছতলার পোস্ট অফিস, বাজারের পুব কোণের রিশিপাড়াটি সতেরো-আঠারো দিনের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। ঘর দুয়ার যে যে পেরেছে সরিয়ে কালীর খিলির ওদিকে চলে যাবে। তারা হয়ে যাবে নিঃস্ব, ভূমিহীন। জমি থাকবে না, ঘর দুয়ার থাকবে না অনেকের। রিশিপাড়ার মানুষগুলো হয়ে যাবে ভাসমান মানুষ। পায়ের তলার মাটি থাকবে না কারোরই।

এই পরিস্থিতিতে কী করবে সম্প্রদায়ের লোকগুলো, কার কাছে হাত পাতবে, কার সাহায্য নেবে, কীভাবে জীবন বাঁচাবে, কীভাবে নিজস্ব একটুকরা জমি হবে, ঘর-দুয়ার হবে, যুবতী মেয়ের বিয়ে দেবে, ছেলে বিয়ে করিয়ে বউ আনবে ঘরে!

রিশি সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেবে মুখচোরা ভুতো। ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠবে রিশিদের একমাত্র ভরসার জায়গা। সম্প্রদায়ের পুরুষদের একত্রিত করে পরামর্শ করবে সে। কীভাবে বাঁচবে সবাই মিলে সে-পরিকল্পনা করবে। ততদিনে দেশগ্রামে
গরু-বরকি মড়ক কমে যাবে। গৃহস্থ লোক নানা প্রকারের ওষুধ-বিষুধ খাওয়াবে গরু-বরকিকে। জীবনগুলো সহজে মরতেই চাইবে না। চামড়ার জোগান পাওয়া যাবে শুধুমাত্র কোরবানের ঈদের সময়। জবাই করা গরু-বরকির ছালচামড়া ছাড়ানোর কাজ রিশিরা পায় না। মুসলমানরা উৎসবে মেতে গরু-বরকি কোরবানি দেয়। নিজেরাই গরু-বরকির ছালচামড়া ছাড়ায়।
দু-চার-পাঁচ টাকায় চামড়া কিনে আনবে রিশিরা। শুকিয়ে টান টান করবে। নৌকা বোঝাই করবে, শুকনা চামড়া নিয়ে পৌঁছে দেবে পশ্চিম 888sport appর ট্যানারিগুলোতে। কাজটা অতীতেও তারা করেছে। তখন রিশিদের নগদ টাকা-পয়সা ছিল। এই কারবারে নগদ টাকাটা লাগে। পদ্মার ভাঙনে নিঃস্ব হওয়া মানুষগুলোর কারবারের সামর্থ্য থাকবে না। তাদের বেঁচে থাকার পথ দেখাবে ভুতো। সে হবে রিশি নেতা।

কী পথ?

ভুতো বলবে, তারা আর পুরনো পেশায় থাকবে না।

যে-পদ্মা তাদের নিঃস্ব করেছে সেই পদ্মাকে আশ্রয় করেই তারা বাঁচবে। তারা জেলে নৌকায় কামলা খাটবে। মাছ ধরবে। যার যা পুঁজি থাকবে ওই নিয়ে মাওয়ার বাজারে মাছ কেনাবেচা করবে। কারবার করতে কেউ কেউ চলে যাবে দিঘলী বাজারে। দিঘলী বড় বাজার। পরিশ্রমে সুফল মিলবে।

ভুতোর পরামর্শে মন্ত্রের মতো কাজ হবে। যে যার মতো কাজে লেগে যাবে। ওদিকে 888sport promo codeরাও বসে থাকবে না। তারা সচ্ছল গৃহস্থবাড়িতে ধান ভানা, ধান সিদ্ধ, পাট লওয়ার কাজ করবে। সবাই মিলে পরিশ্রম করে তারা পায়ের তলার মাটি শক্ত করবে।

হবেও তা-ই। বছর তিনেকের মধ্যে দেখা যাবে রিশিরা অনেকেই পুরোদস্তুর জেলে হয়ে গেছে। নিজের নৌকা আর জাল নিয়ে ইলিশ ধরবে কেউ কেউ। কেউ কেউ করবে মাছ কেনাবেচার কাজ। কালীরখিলের আশপাশটায় খাসজমিতে ঘর দুয়ার তুলে নতুন একখানা রিশিপাড়া গড়ে তুলবে। রিশিদের কেউ কেউ ভালো টাকার মালিক হবে। চামড়া কেনাবেচার ব্যবসায়ও তাদের কারো কারো পেট ফুলেফেঁপে উঠবে।

পুরনো প্রাচীন মানুষেরা, যারা ভুতোর জন্মরহস্য জানে, তারাও তখন ভুতোকে জাউরা পোলা বলবে না। সমীহ করে, আদর সোহাগ করে কথা বলবে তার সঙ্গে। মান্যগণ্য করবে। ভুতো যা বলবে তা-ই হবে রিশিপাড়ায়। রিশিপাড়ার যুবতী মেয়েরা ভুতোর জন্য পাগল হবে অনেকেই। ভুতোর পছন্দ হবে জিতেন রিশির মেয়ে বাসন্তীকে। ভুতোর মায়ের নামে নাম মেয়েটিকেই বিয়ে করবে ভুতো। সে মাছ কেনাবেচার কারবার শুরু করেছে বছর তিনেক আগে থেকেই। বিয়ের পর ধীরে ধীরে সে উন্নতি করতে থাকবে। সাত গণ্ডা জমির ওপর টিনের চৌচালা ঘর করবে। রান্নাঘর করবে আলাদা। বাড়িতে চাপকল বসাবে। পাড়ার রিশি মেয়ে-বউঝিরা খাবার জল নিতে আসবে তার বাড়িতে। বাসন্তী দক্ষ হাতে ভুতোর সংসার সামলাবে। ভুতো আর বাসন্তীর জীবন বয়ে চলবে পদ্মা নদীর মতো। ৎ [চলবে]