চার

লালুবাবুর অবাক হওয়াটা খেয়াল করলেন না পুলিশ অফিসার। আগের মতোই বিনীত গলায় হাসি হাসি মুখে বললেন, আপনি বসুন না স্যার! বসুন, প্লিজ। লালুবাবু কথা না বলে চেয়ার টেনে বসলেন।

এবার অফিসার তার চা-টোস্ট বিস্কুট খাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে লজ্জা পেলেন। চায়ে ভিজিয়ে খাওয়ার পরও টোস্ট বিস্কুটের গুঁড়োগাড়া লেগে থাকে ঠোঁটের কোণে। ডানহাতের চেটোয় লাজুক ভঙ্গিতে ঠোঁট মুছে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, সকালবেলা নাশতা করা হয়নি, স্যার। না, না, আসামি ধরার ব্যাপার ছিল না। বাসায়ই ছিলাম। আমার কোয়ার্টার স্যার থানার পেছনেই। কিন্তু আপনার বউমা নেই। সে গেছে বাজিতপুরে। ওদের বাড়ি স্যার, বামুনগাঁও নামের একটা গ্রামে। ওই বাজিতপুরেই। বাজিতপুর স্টেশান থেকেমাইল তিনেক। রাস্তা খুব ভালো। রিকশা, টেম্পো-ফেম্পো চলে। বাড়ির উঠোন পর্যন্ত রিকশা যায়। আপনি জানেন কি-না জানি না স্যার, জহিরুল ইসলাম সাহেব বাজিতপুরে বিশাল একটা মেডিক্যাল কলেজ করেছেন। তিনি ওই এলাকারই লোক। তবে স্যার মেডিক্যাল কলেজটা যা করেছেন না, অসাধারণ! 888sport appsে এই স্ট্যান্ডার্ডের কোনো মেডিক্যাল কলেজ নেই।

লালুবাবু স্নিগ্ধ গলায় বললেন, আপনার চা ঠান্ডা হচ্ছে। বললেন জলখাবার খাননি, ওটা সারুন, তারবাদে কথা বলি।

কিন্তু আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন স্যার? আমি যত বড়ই হয়ে থাকি, আপনি কেন আমাকে আপনি করে বলবেন! পুলিশ অফিসার হয়েছি বলে আমাকে আপনি করে বলতে হবে না-কি!

পিরিচে 888sport app চায়ের কাপ থেকে পিরিচ সরিয়ে, কাপটি পিরিচে বসিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে লালুবাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন অফিসার। চা খান স্যার, চা খান। দুকাপ চা আনিয়েছিলাম অন্য একটা প্ল্যান করে। চায়ে টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে খেলে দুতিনটা বিস্কুট খাওয়ার পর কাপের চা ফুরিয়ে যায়। টোস্ট বিস্কুটের শোষণক্ষমতা মারাত্মক।

আমি বুঝেছি। এজন্যই বাড়তি এককাপ…

একজাক্টলি। এককাপ চা টোস্ট বিস্কুটের জন্য আরেক কাপ চা চায়ের জন্য।

তাহলে সেই চা-টা যে আমাকে…

না, না, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। এতদিন পর স্যার আপনার সাথে দেখা। খান স্যার, চা খান। আমি এক্ষুনি আরেক কাপ আনিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু যা বলছিলাম সেই ঘটনাটা আগে শুনুন স্যার। জলির বাবার হার্ট অ্যাটাক করেছে। ওহ হো, আপনি তো স্যার বুঝতে পারবেন না, জলি আমার স্ত্রীর নাম। মানে আমার শ্বশুরের হার্ট অ্যাটাক করেছে। বয়স্ক মানুষ, আপনার বয়সী হবে। তবে শরীর-স্বাস্থ্য তেমন সুবিধার না। অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। অবস্থাপন্ন লোক কিন্তু একটু কৃপণ ধরনের। টাকা-পয়সা খরচা করতেই চান না। হার্ট অ্যাটাক করল, তা-ও 888sport appয় আসবেন না। ওই বাজিতপুর মেডিক্যালে ট্রিটমেন্ট করাচ্ছেন। ওখানে অবশ্য ফ্যাসিলিটি সবই আছে। আইসিইউতে ছিলেন। দুদিন হলো কেবিনে আনা হয়েছে। তার মানে এ-যাত্রা বেঁচে গেলেন। কিন্তু আমাদের বাঁচতে দিচ্ছেন না, আমাদের বড় জ্বালাচ্ছেন। ছেলেমেয়ে, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই সবাই দৌড়াচ্ছে বাজিতপুরে। শুধু আমি কাজের দোহাই দিয়ে থেকে গেছি। হাওয়ালদার, এককাপ চা আনো।

লালুবাবু বললেন, চা আনতে হবে না। আপনি এটাই খান। আমি চা খাবো না। খালি পেটে চা খেলে আমার অম্বল হয়।

অফিসার এবার তীক্ষèচোখে লালুবাবুর দিকে তাকালেন। আপনার ব্যাপারটা কী স্যার? আমাকে আপনি আপনি করছেন কেন? আপনি তো নিশ্চয় আমার কাছেই এসেছেন?

হ্যাঁ।

তাহলে, আমাকে কি আপনি চিনতে পারছেন না, না-কি? আমি স্যার বাকি, বাকিবিল্লাহ।

তারপরও আমি আপনাকে ঠিক…

আমি স্যার আপনার ছাত্র ছিলাম। ফরিদপুর হাইস্কুলে আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, আমি স্যার অংকে খুব কাঁচা ছিলাম। আমাদের মহল্লা হচ্ছে উত্তর গোপালপুর। না, না, আপনি আমাদের অংকের টিচার ছিলেন না, আমার প্রাইভেট টিউটর ছিলেন। আপনাদের বাড়ি হচ্ছে গুহলক্ষ্মীপুর। অংকের টিচার হিসেবে আপনার খুব নাম ছিল। অংকের টিচার বলতেই লোকে বুঝত আশুবাবুর নাম। আশুতোষ মজুমদার। বেশিদিন আপনি আমাকে পড়াননি স্যার। এজন্য বোধহয় রিকালেক্ট করতে পারছেন না। কিন্তু আমি স্যার আপনাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি। এতগুলো বছর কেটে গেছে কিন্তু আপনার চেহারা তেমন বদলায়নি স্যার। আপনি আগের মতোই আছেন। এদিকে আমরা গেছি বুড়ো হয়ে।

লালুবাবু বুঝে গেলেন ভুলটা কোথায় হয়েছে। চায়ের কাপটা বাকিবিল্লাহর দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, আমি আশুতোষ মজুমদার নই। আমার নাম লালুদাশ। আমার বাড়ি ফরিদপুরের গুহলক্ষ্মীপুরে নয়।

 বাকিবিল্লাহ বোকার মতো মুখ করে বলল, বলেন কী?

হ্যাঁ। আমি বিক্রমপুরের লোক। এখন থাকি পশ্চিমবঙ্গে।

বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার পুলিশি চোখ আমার সঙ্গে এমন প্রতারণা করল! আপনি একজাক্টলি আশুতোষ মজুমদার। আমার ছেলেবেলার অংকের টিচার আশুবাবু। কতদিন আপনার, মানে আশুস্যারের কানমলা খেয়েছি। একদিন এমন একটা থাপ্পড় মেরেছিল, প্যান্টে মুতে দিয়েছিলাম।

লালুবাবুর এগিয়ে দেওয়া চায়ে আনমনে চুমুক দিলেন বাকিবিল্লাহ। এ-তো দেখি ভয়াবহ কাণ্ড হয়ে গেল। আপনি আশুবাবু নন, আপনি হচ্ছেন গিয়ে লালুদাশ! এ কী করে সম্ভব! আমার চোখ এতবড় ভুল কী করে করল?

আবার তীক্ষèচোখে লালুবাবুর দিকে তাকালেন বাকিবিল্লাহ। না না, আমি কিছুতেই আমার চোখ এবং 888sport sign up bonusকে অবিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি হুবহু আশুবাবু। দুজন মানুষের চেহারার এমন মিল সিনেমা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। ওই যে ডাবল রোলের সিনেমাগুলো আছে না!

পকেট থেকে বেনসন সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন বাকিবিল্লাহ। আপনি যখন আশু স্যার নন তখন আপনার সামনে সিগারেট খেতে আমার নিশ্চয় কোনো অসুবিধা নেই।

তা তো বটেই তা তো বটেই।

সিগারেট ধরিয়ে বাকিবিল্লাহ বললেন, কিন্তু আপনার অসুবিধা কী বলুন তো? মাঝারি সাইজের একজন পুলিশ অফিসার হয়ে আপনাকেআমি এতক্ষণ ধরে স্যার স্যার করে যাচ্ছি, বিনয়ে একেবারে গলে যাচ্ছি, এত স্বাদের চা আর টোস্ট বিস্কুট খাওয়া ভুলে দাঁড়িয়ে রইলাম, শ্বশুরপক্ষের ইতিহাস, ভূগোল, নিজে অংকে কাঁচা ছিলাম সব গড়গড় করে বলে গেলাম, কিন্তু আপনি একবারও বললেন না যে আপনি কিছুই বুঝতে পারছেন না ইত্যাদি ইত্যাদি? আমি না হয় ভুল করছিলাম, আপনি কেন করলেন?

লালুবাবু হাসিমুখে বললেন, আমি দাদা কিছু বুজদেই পারছিলুম না। তাছাড়া আপনি বলছিলেন এত আন্তরিক ভঙ্গিমায়, এত সম্মান-ভক্তি করে, শুনতে বড় ভালো লাগছিল।

আমার কথার কোনো একটা ফাঁক দিয়ে ঢুকে বলে ফেলতেন!

সেই চান্সটাই খুঁজছিলুম। তাছাড়া সকালবেলা এমন একখানা কাণ্ড ঘটল, কী বলব দাদা, তারপর থেকে মুণ্ডুটা মাইরি কোনো কাজই করছে না। একেবারেই বিগড়ে গেছে। এতদিন বাদে দেশে এয়েচি, বেরিয়েছিলুম সকালবেলার 888sport app শহর দেখতে আর তখন কি-না…

ছিনতাইকারীরা ধরেছিল?

লালুবাবু চমকালেন। কী করে বুঝলেন?

আমি পুলিশ অফিসার! 888sport app শহরে কখন কোথায় কী হয় সব আমার জানা। আপনার স্পটটা কোথায়?

রিকশাঅলা বলল, জায়গাটার নাম সেগুনবাগান না সেগুনবাগিচা, কী যেন। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বাকিবিল্লাহ বললেন, বুঝেছি। ও, আপনি তাহলে থানায় রিপোর্ট করতে আসছেন?

আজ্ঞে।

কী কী নিয়েছে?

লালুবাবু বললেন, শুনে হাসবেন বাকিবিল্লাহ। খুবই সামান্য নিয়েছে।

এইটুকুর জন্য রিপোর্ট-ফিপোর্ট করে কোনো লাভ নেই। দুচার লাখ হলে ভালো হতো। আর কাজটা যারা করেছে ওগুলো হচ্ছে ছ্যাঁচড়া ছিনতাইকারী। ডাইল-ফাইল খায়, রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে।

চানমিয়াও তা-ই বলল।

চানমিয়াটা কে?

রিকশাঅলা।

লোকটা কি আপনার পরিচিত?

আজ সকালেই পরিচয় হয়েছে। হোটেলের সামনে…

সে কি আপনাকে থানায় নিয়ে এল?

না, সে আনতে চায়নি। আমি নিজেই এলুম।

রিকশাঅলাটা কোথায়?

থানা কম্পাউন্ডের বাইরে বসিয়ে রেখে এলুম।

বাকিবিল্লাহ হাসলেন। ও আর এখন নেই।

মানে?

ভাগলবা হয়ে গেছে। ছুনুন মোছাই, আপনাদের ওই ঘটিভাছা কিন্তু আমিও কিছু জানি গো। এয়েচি খেয়েচি গেছিলুম দোবোক্ষণ, কী ঠিক হয়েছে না?

লালুবাবু এসব কথা যেন শুনতে পেলেন না। বললেন, না, না, আপনার কথাটা বোধহয় ঠিক না দাদা। চানমিয়া পালাবে না। ওর ভাড়া রয়ে গেছে। তিন-সাড়ে তিনঘণ্টার পয়সা, ঘণ্টা পয়তাল্লিশ টাকা।

হোক। তবু সে পালিয়েছে।

কারণ?

কারণ ওই বদমাশগুলোর সঙ্গে এই ধরনের রিকশাঅলাদের একটা যোগাযোগ থাকে। বিদেশী কিংবা নিরীহ ধরনের মক্কেল পেলে ওরা তাদেরকে এমন সব রাস্তায় নিয়ে যায় যেখানে ওই বাঞ্চোতরা থাকে। ছিনতাই করিয়ে দিয়ে পরে গিয়ে নিজেদের শেয়ার বুঝে নেয়।

বাকিবিল্লাহর কথার সঙ্গে চানমিয়ার কথাবার্তা আচার-আচরণ মেলাবার চেষ্টা করলেন লালুবাবু। তেমন একটা মিল পেলেন না। যদি তেমন হতো তাহলে ছোকরাগুলো চানমিয়ার সঙ্গে নিশ্চয় ওই ধরনের আচরণ করত না। চানমিয়া যদি ওদের নিজেদের লোকই হতো তাহলে তার সঙ্গে অমন চোখরাঙানি কিংবা ধমকা-ধমকি কেন করবে? বাকিবিল্লাহ যে-সমস্ত কথা বললেন ওই ভাবনা প্রথমে লালুবাবুরও হয়েছিল। পরে মিলিয়ে দেখেছেন, না, ব্যাপারটা তেমন নয়। না-কি বাকিবিল্লাহর কথাই ঠিক, চানমিয়ার আচরণটা ছিল সাজানো নাটক!

বাকিবিল্লাহ বললেন, কী ভাবছেন দাদা? আপনি বিদেশী মানুষতো, এতকিছু বুঝবেন না। রিকশাঅলাটাকে যত ভালোই আপনার মনে হোক, মোটেই সে ভালো না। সে ওদেরই লোক। আমরা পুলিশ। চোর-বদমাশ হাবিজাবি মানুষ চড়িয়ে খাই। আপনি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সব বুঝে গেছি। যদি আমার কথা আপনার বিশ্বাস না হয়, থানার বাইরে যান, গিয়ে দেখেন আপনার ওই চানমিয়া নেই। সে ভাগলবা হয়ে গেছে।

লালুবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তাহলে আমি একটু দেখেই আসি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়।

বাইরে এসে হতভম্ব হয়ে গেলেন লালুবাবু। সত্যি সত্যি চানমিয়া নেই। যেখানে রিকশা নিয়ে বসে থাকার কথা তার সেই জায়গাটা ফাঁকা। আশ্চর্য ব্যাপার! তাহলে পুলিশ অফিসারের কথাই ঠিক! সে ওই ছোকরাদের দলের। কিন্তু ওরা নিয়েছে এক হাজার টাকা আর একটা ঘড়ি। ঘড়ি জিনিসটা আজকাল খুব সস্তা হয়েছে গেছে। দু-তিনশো টাকায় দারুণ দারুণ ঘড়ি পাওয়া যায়। লালুবাবুর ঘড়িটা দুশো পঁচিশ টাকা দামের। আট-দশ বছর আগের কেনা। তখনকার দুশো পঁচিশ টাকা অনেক টাকা। এত বছর পর সেই ঘড়ি বেচতে গেলে পঞ্চাশ-একশো টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। নগদ এক হাজার আর ঘড়িবেচা ওই টাকা, সব মিলিয়ে সাড়ে দশ-এগারোশো টাকা, ছোকরারা ছিল তিনজন আর যদি চানমিয়াও তাদের পার্টনার হয়ে থাকে, তাহলে চারজনের মধ্যে ভাগ হবে ওই টাকা। সমান ভাগ হলে আড়াইশো টাকার কিছু বেশি পাবে চানমিয়া। তারপরও বেচারার বেশ লসই হলো। লালুবাবু যদি থানায় না আসতেন তাহলে পয়তাল্লিশ টাকা ঘণ্টা হিসাবে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার পয়সা!

আরে এই ধরনের রিকশাঅলাদের তো তাহলে ম্যালা রোজগার! ডেইলি যদি দুখানা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে আর তিন-চার ঘণ্টা রিকশা চালায় তাহলে তো পাঁচ-সাতশো টাকা নিয়ে ঘরে ফেরা যায়!

কাজটায় রিস্কও অবশ্য আছে। ধরা পড়লে হালুয়া টাইট হয়ে যাবে। না-কি থানা-পুলিশের সাথেও তাদের একটা যোগাযোগ আছে। এইসব চুরি-ছ্যাঁচড়ামির টাকার বখরা নাকি পুলিশরাও পায়। বোম্বের সিনেমাতে এই ধরনের ঘটনা অনেক দেখা যায়। নাটক, সিনেমা, গল্প, 888sport alternative link এসব তো বাস্তব জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।

চানমিয়া নেই তারপরও লোকটিকে অন্তর থেকে খারাপ ভাবতে পারছেন না লালুবাবু। মনে হচ্ছে চানমিয়া ঠিক ওরকম নয়। হয়ত অন্য কোনো কারণে পালিয়েছে সে। কথায় আছে না, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। হয়ত সেই আঠারো ঘা এড়াবার জন্যই পালিয়েছে লোকটা।

 না-কি রাস্তার ওপাশের চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে! বলেছিল না সময়-সুযোগ পেলে আয়েশ করে এককাপ চা আর একটা সিগারেট খায় সে।

লালুবাবু রাস্তার ওপারে এলেন। চায়ের দোকানগুলোতে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন চানমিয়াকে। না, সে নেই। হতাশ ভঙ্গিতে থানায় ফিরে এলেন লালুবাবু। তাঁকে দেখে হাসলেন বাকিবিল্লাহ। কী হলো দাদা, পেলেন আপনার চান্দুকে?

লালুবাবু লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।

বলেছিলাম না! আরে এসব আমাদের মুখস্থ। রোজ এরকম দুচারটা কেস ডিল করি। বলুন, এই অবস্থায় আপনার জন্য কী করতে পারি?

একটা রিপোর্ট লেখানো দরকার না?

হ্যাঁ, কিন্তু সেই কাজটার জন্য আপনার পাসপোর্ট লাগবে। পাসপোর্ট আছে সঙ্গে?

না।

তাহলে কী করে হবে! তাছাড়া এটা মনে হয় ভুলে যাওয়াই ভালো। ক্যাশ একহাজার টাকা আর ওই একটা ঘড়ি। এই সামান্য জিনিসের জন্য এত হাঙ্গামার দরকার কী?

তা অবিশ্যি ঠিকই বলেছেন। তাহলে এলুম দাদা, নমস্কার।

লালুবাবু মাত্র পা বাড়িয়েছেন, বাকিবিল্লাহ বললেন, দাদা শুনুন, আপনি উঠেছেন কোথায়?

গ্র্যান্ড আজাদ হোটেল। পুরানা পল্টনে। কিন্তু ওখানে থাকব না। আজ বিকেলেই চলে যাব বিক্রমপুরে। তিনচারদিন পর ফিরে কোথায় উঠব তা এখনও জানি না। দিন-সাতেক পর তো চলেই যাব।

তবু কোনো একটা ফোন নাম্বার কিংবা ঠিকানা যদি দিয়ে যান, না, না, কোনো কারণ নেই, এমনি রাখছি আর কি?

ওয়াদুদ খানের বাড়ি এবং অফিসের ফোন নাম্বার লেখা        আছে মানিব্যাগে রাখা ছোট্ট টেলিফোন ইনডেক্সে। সেটা বের করে নাম্বারগুলো বললেন লালুবাবু, খসখস করে সামনে রাখা থানার প্যাডে নাম্বারগুলো লিখে রাখলেন বাকিবিল্লাহ।

জয়িতা মারমুখো ভঙ্গিতে দরজা খুলল। ভেতরে ভেতরে রাগে একেবারে ফেটে পড়ছে সে। এক্ষুনি বুড়ো মানুষটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাকে না বলে এভাবে কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি? আর গিয়েই যখন ছিলে আমি ঘুম থেকে উঠবার আগে ফিরে আসোনি কেন? আমার যে টেনশান হতে পারে বোঝনি! আর চান করার পর আমার যে বেজায় খিদে পায় জানো না তুমি? কোথায় গিয়েছিলে বলো? এতক্ষণ কী করলে বলো!

কিন্তু দরজার বাইরে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি লালুবাবু নন, ওয়াদুদ খান।

জয়িতা থতমত খেল। মারমুখো ভঙ্গি বদলে হাসল। ওয়াদুদদা আপনি? আসুন, ভেতরে আসুন।

ওয়াদুদ খান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, লালুদা কোথায়? রুমে নক করলাম, খুললো না তো?

 সে তো নেই।

কই গেছে?

বলতে পারি না। আমাকে কিছু বলে যায়নি।

 তোমারে না বইলা এত সকালে সে কোথায় যাইব? একলা একলা তো তার কোনোখানে যাওনের কথা না।

কিন্তু গিয়েছে তো?

কখন গেল?

সকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সবই বলল জয়িতা। শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন ওয়াদুদ খান। আরে এইটা কেমুন কথা? এইভাবে কোথায় যাইবো গা সে।

আমি তো কিছুই বুজদে পারছি না।

আমিও তো বুঝতে পারতেছি না।

ওয়াদুদ খান চিন্তিত হয়ে গেলেন। তাঁর পরনে ঘিয়া রঙের স্যুট, কোটের তলায় আকাশি রঙের দামি শার্ট, চমৎকার একটা টাই ঝুলছে গলায়। পায়ে খয়েরি রঙের চকচকে জুতো। গা থেকে সুন্দর একটা পারফিউমের গন্ধ আসছে। সেই গন্ধে জয়িতার রুমটা যেন স্নিগ্ধ হয়ে গেছে।

কিন্তু জয়িতার এসবে মন নেই, তার মন পড়ে আছে লালুবাবুর দিকে। কোথায় গিয়েছেন তিনি? এখনও ফিরছেন না কেন? হোটেলের রুমে একা পড়ে আছে যুবতী নাতনি, তার কথা ভাবছেন না!

ওয়াদুদ খান বললেন, এইভাবে একলা একলা বাইরে যাওয়া তার ঠিক হয় নাই। 888sport app শহর আইজকাইল একদম নিরাপদ না। কতপদের ঘটনা ঘটে। তার উপরে সে হইল ইন্ডিয়ান মানুষ। বিদেশী। এই দেশের হাব-ভাব কিছুই বুঝবে না। কোনো বিপদ-আপদ ঘটলে…

জয়িতা আকুল গলায় বলল, তাহলে কী করা যায় এখন? সাড়ে দশটা বাজে। দাদুর কোথাও কোনো বিপদ-আপদ ঘটেনি তো?

জয়িতাকে ভেঙে পড়তে দেখে শান্ত করেন ওয়াদুদ খান। আরে না। তুমি এতো চিন্তা কইরো না। আমার মনে হয় তুমি ঘুমাইতাছো দেইখা দাদায় একটু ঘুরতে ফিরতে গেছে। এখনই আইসা পড়ব।

কিন্তু এতক্ষণ হয়ে গেল…

আইসা পড়ব, আইসা পড়ব। চিন্তা কইরো না। তুমি নাশতা করছ?

না। এই অবস্থায় কী করে জলখাবার খাবো? দাদু নেই, টেনশান হচ্ছে।

না, না, টেনশান কইরো না। নাশতা খাইয়া লও। এই রুমে আনাইয়া দিমু না রেস্টুর‌্যান্টে গিয়া খাইবা?

এখানেই খাই, ওয়াদুদদা, আপনি খেয়েছেন?

আরে না। ভাবলাম তোমগ লগে আইসা খামু।

তাহলে খান।

হ, হ, একলগেই খামু। লালুদার নাশতাও আনাই। দেখবা নাশতা আসতে আসতে লালুদাও আইসা পড়বে নে। আইচ্ছা শোনো, কী খাইবা?

তেমন কিছু না। বাটার টোস্ট, ওমলেট আর চা।

ঠিক আছে।

ইন্টারকম তুলে রুমসার্ভিসে নাশতার অর্ডার দিলেন ওয়াদুদ খান। সেই ফাঁকে জয়িতা খেয়াল করল ওয়াদুদ খানের মুখে সূক্ষ্ম একটা    চিন্তার ছাপ যেন খেলা করছে। কী রকম একটু আনমনা দেখাচ্ছে তাঁকে। কী ভাবছেন? লালুবাবুর কথা? লালুবাবুর এইভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার কারণে কি তিনি উদ্বিগ্ন? জয়িতা ভয় পাবে বলে কিছু বলছেন না ঠিকই কিন্তু নিজে নিজে ভেঙে পড়ছেন।

এসব ভেবে জয়িতা যেন আরো দিশেহারা হলো। ওয়াদুদ খানকে দেখে, তাঁর কথাবার্তা শুনে যে ভরসাটা পেয়েছিল সেই ভরসা এখন যেন আস্তে আস্তে ভাঙছে। যদি রাস্তাঘাটে কিছু ঘটে থাকে দাদুর? যদি সে আর কখনও ফিরে না আসে?

ইন্টারকম রেখে ওয়াদুদ খান বললেন, আমার তো এই সময় আসনের কথা না। আইজ তোমগ এইখানে আমার আসনেরই কথা না। দোফরে নীপেশ তালুকদার, দিপালী নাগ তাঁরা আসবেন। তাগো রিসিভ করতে যাওনের কথা। তাগো লইয়া অবশ্য এই হোটেলেই আসুম। এখানে রুম বুক করা আছে। তাঁরা আইসা ইকটু ফ্রেশট্রেশ হইয়া আবার রওনা দিবো। আইজই তাগো লইয়া যামু বিক্রমপুর। তার আগে খোকন আইসা লইয়া যাইব তোমগ। সকালবেলা উইঠা ভাবলাম, কোনো কাম নাই, তোমগ লগে ইকটু দেখা করি। এই মনে কইরা আইলাম।

এটা খুবই ভালো করেছেন। নয়ত টেনশানে এতক্ষণে আমি মরেই যেতাম।

আরে না, টেনশানের কিছু নাই। শোন, অমিত তালুকদার আসতে পারতাছেন না। তিনি হইলেন কইলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি। বিরাট মানুষ। আমগ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অভয় তালুকদার সাহেবের নাতি। এখন আসতাছেন দিপালী নাগ, নীপেশ তালুকদার আর তার বউ। রূপালী নাগেরও আসনের কথা আছিল, তিনিও আসতে পারতাছেন না। ওনারা সবাই অভয় তালুকদার সাবের বংশধর। দিপালী নাগ সম্বন্ধে তো মনে হয় জানোই, বিরাট নামকরা 888sport live chatী। তয় পুরানা দিনের। আইজ কাইলকার মাইনষে তারে চিনব না। তাঁর লগে পাঁচ-ছয়জন 888sport live chatীও আসতাছে। আমগ অনুষ্ঠানে গান গাইব। তাঁরা সবাই বিক্রমপুরের না। আসতাছে গান গাইতে। তয় এলাকার বেবাক মাইনষে যার আশায় আছিল, সে হইল জলধর ডাক্তার। বাদলদায় কইছিল জলধর ডাক্তার যতদিন থাকব সে তার লেইগা একখান গাড়ি দিয়া দিবো। কিন্তু জলধর ডাক্তার আসতে পারতাছেন না। বুড়া হইয়া গেছে। শইল ভালো না। এই অবস্থায় পোলাপানে তারে আসতে দিবো ক্যান?

কারে আসতে দিবো ক্যান? কার কথা কইতাছো? বলতে বলতে লালুবাবু বেশ উৎফুল্ল মুখে জয়িতার রুমে ঢুকলেন। তাঁকে দেখে দুজন মানুষ উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। জয়িতা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, কেমন আক্কেল তোমার বলো তো? কোথায় চলে গিয়েছিলে এইভাবে? এদিকে হোটেলে কত কাণ্ড ঘটে গেল! ডুপ্লিকেট চাবি আনিয়ে…

এতটা দেরি হয়ে যাবে ভাবিনি বুঝলি? ম্যালা সকালে ঘুম ভাঙল, ভাবলাম একটু বেরিয়ে আসি। বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূর চলে গেলুম…

আসল ঘটনা সবই চেপে গেলেন লালুবাবু। কিছুই বললেন না। ওসব বললে ওই নিয়ে অনেক কথা খরচা করতে হবে এখন। জয়িতার অনেক গালমন্দ শুনতে হবে। ওয়াদুদ খানও নিশ্চয় জ্ঞানদান করবেন। এইটা আপনে ঠিক করেন নাই, দাদা। ছিনতাইকারীরা যদি গুল্লি কইরা দিত…

লালুবাবু ওয়াদুদ খানের দিকে তাকালেন। তুমি আসলা কখন? তোমার তো আসনের কথা না।

হ, তারপরও আসলাম। আমি না আসলে তো আপনে অনেক বড় বিপদে পড়তেন দাদা।

কিসের বিপদ?

জয়িতা আপনেরে অহন খাইয়া ফালাইতো। যেই রাগ রাগছে।

হ, এইডা ঠিকই কইছো। তোমার সামনে বেশি কিছু কইতে পারবো না।

দাদু ফিরে আসার পরই মনটা ভালো হয়ে গেছে জয়িতার। এখন আর রাগারাগি করতে ইচ্ছেও করছে না। বুড়ো হলে মানুষ যায় শিশু হয়ে। লালুবাবুও শিশু হয়ে গেছেন। শিশুরা তো উলটোপালটা কাজ কিছু করবেই। ওই নিয়ে কথা বলে লাভ কী?

 বেয়ারা এ-সময় নাশতা নিয়ে এল। নাশতা দেখেই বেজায় একটা খিদে টের পেলেন লালুবাবু। মুগ্ধ গলায় বললেন, ইস, একেবারে টাইমলি জলখাবারটা এনেছে রে? বেদম খিদে পেয়েছে। দে ভাই, খাবারটা তুলে দে।

জয়িতা কথা না বলে কোয়ার্টার প্লেটে খাবার তুলে প্রথমে ওয়াদুদ খানকে দিল তারপর দিল লালুবাবুকে। সবশেষে নিজে নিয়ে টোস্টে কামড় বসাল।

খাওয়া শেষ করে চায়ে চুমুক দিয়েই ইন্টারকম তুললেন ওয়াদুদ খান। একটা নাম্বার চাইলেন।

লালুবাবু বললেন, কারে ফোন করো ওয়াদুদ?

মিলন সাহেবরে। ইমদাদুল হক মিলন। বহুত নামকরা 888sport live footballিক।

তাঁর কাছে তোমার কী কাম?

আরে সে তো আমগ স্কুলের ছাত্র। ক্লাস টু থিকা ফাইভ পর্যন্ত কাজির পাগলা স্কুলে পড়ছে। তার বড়ভাই আজাদ আমার লগে পড়ত। আমরা যে ম্যাগাজিনটা বাইর করতাছি সেইটা সম্পাদনা করতাছে সে আর আলী আহামেদ ভাই। দুইদিনের অনুষ্ঠানও পরিচালনা করব তারা। আমি চাইতাছি বিদেশী মেহমান আপনেরা যারা আইছেন তাগো পরিচিতিমূলক একখান অনুষ্ঠান করুম। সেই অনুষ্ঠানটা আমি পরিচালনা করতে চাই। মিলন সাবরে আগেই বলছি, এখন আরেকবার বইলা দেই। এ-সময় টেলিফোন বাজল, লাইন পাওয়া গেছে। ওয়াদুদ খান বিনীত ভঙ্গিতে ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। জয়িতা এবং লালুবাবু দুজনের হাতেই চায়ের কাপ। লালুবাবু কী রকম অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন, কী রকম চিন্তিত দেখাচ্ছে তাঁকে। ব্যাপারটা খেয়াল করল জয়িতা কিন্তু ওই নিয়ে কোনো কথা বলল না। মনের ভেতর গোপন করে রাখল। পরে এই নিয়ে কথা বলা যাবে। (চলবে)