ছয়
এমনও তো হয়, জীবনের কোনো কোনো মুহূর্তে অতীত এবং বর্তমান একাকার হয়ে যায়। একাকার হয়ে তৈরি করে আশ্চর্য রকমের এক ঘোর!
সেই সকালে আমার কিন্তু তা-ই হলো। অতীত এবং বর্তমানের মিশেলে তৈরি হওয়া ঘোরে আচ্ছন্ন হলাম আমি। নিজের অজান্তেই কথাটা বললাম ডালুকে। শুনে একটু যেন বেশিই অবাক হলো ডালু, একটু যেন বেশি জোরেই বলল, জ্বি?
সেই শব্দে ঘোর কেটে গেল আমার। অতীত এবং বর্তমান আলাদা হয়ে গেল। একটু লজ্জাও পেলাম। না কিছু না।
মোতালেব মামার কথা জানি কী কইলেন?
হ, হঠাৎ ক্যান জানি মোতালেব মামার কথা মনে হইল।
ও।
মোতালেব মামায় অহন কী করে রে?
কী আর করব? আগে যা করতো তাই। গরু-মরু পালে, মাতবুরি-মুতবুরি করে।
অবস্থা কেমুন?
খারাপ না। যাত্রাবাড়ি না শনির আখড়া কোন জাগায় বলে দুই-তিনকাঠা জাগা কিনছে।
কচ কী! তয় তো অবস্থা ভালোঐ।
হ। হেই জাগায় বলে ঘরদুয়ার উডাইছে। ভাড়া দিছে। বড় মাইয়ার বিয়াও দিছে ভালো জাগায়। জামাইর অবস্থা ভালো।
তারপর আমার বড়ভাই আজাদের কথা বলল ডালু। দাদায় বলে হেই বিয়ায় পাঁচ না দশ হাজার টেকাও দিছে।
দিতে পারে। শহীদ সাবের লগে তাগো খাতির আছে।
আজাদের ভালো নাম শহীদুল হক খান। ঠিক একই নামে আমাদের এক খালাতো ভাই আছেন। মার মেজো চাচার প্রথম পক্ষের বড়মেয়ে সাফিয়া খালার ছেলে। সাফিয়া খালার দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় শেফালি আপা, তারপর বাবুলদা, মানে শহীদুল হক খান তারপর নিম্মি। বাবুলদাকে এখনও বাবুলদাই বলি আমি।
আর সবাই বলে শহীদ ভাই।
তিনি বিখ্যাত মানুষ। এক সময় ফিল্ম জার্নালিজম করতেন, বেশ কয়েকটি দুর্দান্ত সিনেমা-পত্রিকা-সম্পাদনা করেছেন। স্টেজ-নাটক লিখেছেন, রেডিও-টিভিতে প্রচুর নাটক লিখেছেন, তৈরি করেছেন। সুন্দর উচ্চারণে চমৎকার করে কথা বলেন। বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করেছেন। উপস্থাপক হিসেবে দারুণ। এক সময় দুটো সিনেমা করেছিলেন বাবুলদা। বিখ্যাত লেখক সমরেশ বসুর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। সমরেশ বসুর ছুটির ফাঁদে 888sport alternative linkটি চিত্রায়িত করেছিলেন শহীদুল হক খান, মানে আমার বাবুলদা। কলকাতা থেকে আরতি না ঝুমুর গাঙ্গুলি কী যেন একজন নায়িকা এনেছিলেন। স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পরের ঘটনা। পত্রপত্রিকায় তখন প্রায়ই ছুটির ফাঁদের নিউজ। নায়িকার বিরাট বিরাট ছবি, বাবুলদার সাক্ষাৎকার। অর্থাৎ খুবই গ্লামারাস একজন মানুষ বাবুলদা।
বাবুলদার বাবা আজিজুল হক খান সাহেব ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট মানুষ। কলকাতা না যাদবপুর কোন ইউনিভার্সিটি থেকে অংকে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। আমার মেজোনানা আরও পড়াবার প্রলোভন দেখিয়ে নাকি সাফিয়া খালাকে তাঁর কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। পরে সেই প্রতিজ্ঞা রাখেননি বলে খান সাহেব জীবনে কোনওদিনও শ্বশুর বাড়িতে যাননি। চাকরি করতেন এজিবিতে। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে অংকের টিউশনি করতেন। অংক জানা শিক্ষক ছাত্রদের কাছে খালুজান ছিলেন একজন পরম শ্রদ্ধেয় মানুষ। থাকতেন মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে। সেই বাসায় দু-চার মাসে এক আধবার যাওয়া হতো আমাদের। কিন্তু খালুজান কিংবা বাবুলদার সঙ্গে দেখা হতো কম। কম না বলে হতো না বলাই ভালো। কারণ তাঁরা দুজন দুজগতে ব্যস্ত। একজন অংকে আরেকজন সিনেমা-নাটকে।
শ্বশুরের ওপর যেমন অভিমান ছিল খালুজানের, ছেলের ওপরও ছিল কিছুটা। তিনি চেয়েছিলেন পড়াশুনায় নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা ছেলের মাধ্যমে পূর্ণ করবেন। কিন্তু ছেলে অংকের জটিল জগতে প্রবেশই করল না। কলেজে পড়ার সময় থেকেই বাবুলদা আস্তে ধীরে চলে গেলেন লেখালেখির দিকে। সাংবাদিকতা, পত্রিকা-সম্পাদনা, নাটক-সিনেমা – এই জগৎ তাঁকে আচ্ছন্ন করল।
আমার সাফিয়া খালা ছিলেন অসাধারণ সুন্দর একজন মানুষ। তাঁর শারীরিক সৌন্দর্যের যেমন তুলনা ছিল না, মনের সৌন্দর্যেরও তুলনা ছিল না। ছেলেকে বুক দিয়ে আগলে রাখতেন তিনি। স্বামীর অভিমানের ছায়াও পড়তে দিতেন না ছেলের ওপর। ছেলের প্রতিটি কাজে তাঁর ছিল গভীর মমত্ববোধ। আর আমার খালুজানও ছিলেন স্ত্রীর ওপর
সর্বান্তকরণে নির্ভরশীল। মনে পড়ে না, এত সুন্দর দম্পতি আমি আর দেখেছি কি-না!
আমার খালার চরিত্রের অনেকখানিই পেয়েছে নিম্মি। খালার শরীর এবং মনের সৌন্দর্য পেয়েছে।
সাফিয়া খালা মারা গেলেন ক্যান্সারে। সেই সময় কয়েকবার খালাকে দেখতে গেছি। নিম্মিকে দেখেছি সবসময় খালার পাশে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় একেবারেই ভেঙেচুরে গেছে সে। যেন ক্যান্সারটা খালার হয়নি, হয়েছে নিম্মির। খালার মৃত্যুর পর বহুদিন স্বাভাবিক হতে পারেনি নিম্মি। দু-একদিন ফোনে আমার সঙ্গে কথা হতো। কথা বলতে বলতে আমরা দুজন চলে যেতাম বহুদূর পেছনে ফেলে আসা এক জীবনে। আমাদের সেই জীবনকে ঘিরে ছিল কত যে দুঃখ-বেদনা, জীবন-সংগ্রামের ফাঁকে বেঁচে থাকার আনন্দ আর স্বপ্ন। খালার মৃত্যুর পর আমরা দু ভাইবোন নানারকম 888sport sign up bonusতে আচ্ছন্ন হতাম। খালার কথা বলতে বলতে কখন যে কাঁদতে শুরু করত নিম্মি, আমারও যে চোখ ভেসে যেত কোন ফাঁকে, টের পেতাম না।
ছুটির ফাঁদের পর কলমিলতা নামে একটি ছবি করেছিলেন বাবুলদা। মুক্তিযুদ্ধের ছবি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁকে খুব পছন্দ করতেন, শুনেছি।
বাবুলদার কথা ভাবলেই আমার মনে পড়ে দুটো ঘটনার কথা। দেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। আমি মেদিনী মণ্ডলে। শুনলাম কাজির পাগলা স্কুলের মাঠে বিকেলবেলা কী একটা অনুষ্ঠান হবে। জাহাঙ্গীর, আলমগীর, তাজল, দুলালদের সঙ্গে গেছি সেই অনুষ্ঠান দেখতে। এমন কিছু অনুষ্ঠান নয়, মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করার জন্য একত্রিত হয়েছেন। সেই অনুষ্ঠানে দেখি বাবুলদা। সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পরেছেন, কনুই পর্যন্ত হাতাগুটানো। কী যে চমৎকার একটা বক্তৃতা দিলেন তিনি! শুনে আমি মুগ্ধ। মনে হলো, আহা এত সুন্দর করে আমি যদি কখনও বক্তৃতা দিতে পারতাম!
সেই মুহূর্ত থেকে বাবুলদা আমার হিরো হয়ে গেলেন।
একাত্তর সালে আব্বা মারা গেলেন, আমাদের যে কী দুর্দিন। জগন্নাথ কলেজে পড়ি, টিউশনি করি। একটু একটু লিখতেও শুরু করেছি। সেই সময় বাবুলদা ‘ছুটির ফাঁদে’ করছেন। কলকাতা থেকে নায়িকা এনে রেখেছেন ‘পূর্বাণী’ হোটেলে। একদিন কী কাজে পূর্বাণীর সামনের ফুটপাথ দিয়ে অসহায়ের মতো হেঁটে যাচ্ছি, দেখি চমৎকার হাওয়াই শার্ট পরা বাবুলদা পূর্বাণী থেকে বেরিয়ে এলেন। গেটের সামনে ঝকঝকে নীল রংয়ের একটা গাড়ি, ড্রাইভার বিনীত ভঙ্গিতে দরজা খুলে দাঁড়াল, বাবুলদা কোনওদিকে না তাকিয়ে গাড়িতে উঠলেন। আমার পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল গাড়ি।
পরিষ্কার মনে আছে, এই অবস্থায় মনের অবস্থা যা হওয়া উচিত, দুঃখ পাওয়া বা ঈর্ষান্বিত হওয়া তা কিন্তু আমার হলো না। বরং আশ্চর্য এক গৌরবে মন ভরে গেল। ইচ্ছে হলো আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজনকে ডেকে বলি, এই যে গাড়ি করে চলে গেলেন ভদ্রলোক, তিনি আমার ভাই। আমার বাবুলদা।
সাফিয়া খালা ছিলেন আমার মায়ের বড়। কিন্তু কী যে পাগল ছিলেন দুজন দুজনার জন্য! কী যে ভালোবাসতেন দুজন দুজনকে। একারণেই দুজনেরই ছেলের ভালো নাম এক কি-না কে জানে! দুজনেরই স্বামীর পদবি খান, এও এক আশ্চর্য মিল।
একাত্তর সালে আব্বা মারা যাওয়ার সময় জগন্নাথ কলেজে আইকম পড়ত আজাদ। নাইট শিফটে। আমি আর মণি এসএসসি দেব। যুদ্ধের কারণে সব বন্ধ হয়ে আছে।
নাইন-টেনে পড়ার সময় থেকেই আমরা দুভাই আব্বাকে সাহায্য করতে শুরু করেছিলাম। দুজনেই টিউশনি করতাম। একেকটা টিউশনিতে দশ কিংবা পনেরো টাকা। গেণ্ডারিয়া হাইস্কুলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি করতাম দু-তিনটা, আজাদ পাঁচ-ছটা পর্যন্ত টিউশনি করেছে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে টঙ্গি ব্রিজের ওপারে, হাতের বাঁ পাশের কী একটা অফিসে কেরানির চাকরি পেয়েছিল সে। গেণ্ডারিয়া থেকে টঙ্গিতে গিয়ে সেই চাকরি করত সে।
নাইনে পড়ার সময় আমাকে প্রথম টিউশনি যোগাড় করে দিয়েছিলেন আব্বা। সূত্রাপুর বাজারের পশ্চিমপাশের গলির ভেতর এক 888sport appইয়া ভদ্রলোকের ওয়ানে পড়া মেয়েকে পড়াতে হবে। ভদ্রলোক আব্বার পরিচিত। স্কুল শেষ করে সন্ধ্যার দিকে আমি পড়াতে যাই। ছাত্রী পড়ানোয় আমার তেমন মন থাকে না, মন থাকে অন্যলোভে। কখন চা-বিস্কিট খেতে দেবে, কখন খিদে কমবে আমার। কারণ তখন প্রায় সারাক্ষণই ক্ষুধার্ত আমি। এতগুলো ভাইবোনের সংসার, আব্বা কেরানির চাকরি করেন, ভরপেট খাবার কোথায় পাব!
সেই বাড়িতে চায়ের আগে খুব লোভনীয় একটা খাবার দিত। বেশ বড় সাইজের একখানা আমের মুরব্বা। মুরব্বার সঙ্গে লেগে থাকত চিনির গাঢ় রস। বিক্রমপুর অঞ্চলে এই রসকে বলে ‘সিরা’। মুরব্বাটা আমি কী যে আগ্রহ করে খেতাম! মুরব্বা শেষ করে পিরিচে লেগে থাকা সিরাটা আঙুলের ডগায় তুলে বহুদিনের অনাহারি মানুষের মতো চেটে চেটে খেতাম। দেখে ওয়ানে পড়া ছাত্রীটি মিটিমিটি হাসত।
পরে বুঝেছিলাম, আমের মুরব্বা ওই বাড়ির লোক পছন্দ করে না বলে আমাকে খাইয়ে খাইয়ে বয়াম খালি করছিল। অথচ আমের মুরব্বা, কাশ্মিরি আচার এসবের কী পাগলই না আমরা ছিলাম। আমের দিনে বুজি আর পুনুআম্মা কত যত্নে এসব তৈরি করতেন, আমি আর আজাদদা সারাক্ষণ ছোক ছোক করতাম কখন একটু খেতে পাব। চুরির ধান্দায়ও কম থাকিনি। বয়াম ভরে ভরে আমের মুরব্বা আর কাশ্মিরি আচার বানিয়ে রাখতেন বুজি। কেবিনের ভেতর দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ‘কারে’। সেই কারের অন্ধকারে সাজিয়ে রাখতেন আচার-মুরব্বার বোতল-বয়াম। চান্স পেলেই আমরা দুভাই চুরি করে খেতাম সেই জিনিস। কোনো কোনো সময় বোতল খালি হওয়ার পর ধরা পড়ে গেছি।
আর সেই আশ্চর্য জিনিস এই বাড়িতে কেউ খায় না! আমাকে খাইয়ে খাইয়ে বয়াম খালি করছে!
মনে আছে মুরব্বার লোভে একটি দিনও টিউশনি মিস দিইনি আমি। তখন সাপ্তাহিক ছুটি ছিল রোববার। আমার ইচ্ছে করত রোববারও পড়াতে যাই। গেলেই তো মুরব্বা।
কিন্তু মুশকিল হলো মাসশেষে, বেতনের সময়। এক তারিখ যায়, দুই তারিখ যায়, দশ তারিখ চলে যায়, দশটা টাকা বেতন আমার, সেই টাকাটা আর দেয় না। লজ্জায় মুখ ফুটে চাইতেও পারি না। মা প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, কী রে, বেতন পাছ নাই?
শেষ পর্যন্ত আব্বাকে বললাম। আব্বা বোধহয় সেই লোককে বললেন, ষোলো-সতেরো তারিখের দিকে বেশ মুখকালো করে তারা আমাকে টাকা দশটা দিল।
জীবনে সেই প্রথম আমার বেতন পাওয়া! কী যে আনন্দ হয়েছিল! মাত্র দশটি টাকা দেখে গভীর আনন্দে উজ্জ্বল হয়েছিল আমার মায়ের দুঃখী মুখ। আজ কোটি টাকার বিনিময়েও মায়ের মুখের সেই উজ্জ্বলতা আমি ফিরিয়ে আনতে পারব না। চার-পাঁচ বছর ধরে মা আমার শয্যাশায়ী। তাঁর 888sport sign up bonus কাজ করে না, অনেক কথা বলেন, বেশির ভাগই বোঝা যায় না। বেশ কয়েকবার মৃত্যু তাঁর শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভাইবোনদের মধ্যে বড় ছেলেকেই বেশি ভালোবাসেন আমার মা। গ্রামের লোকেরা এখনও আমার মাকে বলে আজাদের মা। কিন্তু আমার ভাইয়ের সেই নামটি আস্তে-ধীরে মুছে যাচ্ছে।
আব্বা মারা যাওয়ার পর এক-দেড় বছর পর সিটি করপোরেশনে চাকরি হলো আজাদের। তখনও সিটি করপোরেশন হয়নি, 888sport app মিউনিসিপ্যাল কমিটি অথবা 888sport app মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন ছিল প্রতিষ্ঠানটির নাম। অফিস লক্ষ্মীবাজারে। টঙ্গির চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে জয়েন করল সে। আসলে জয়েন করার কথা ছিল আমার। আব্বা মারা যাওয়ার পর আমাদের সংসারের চেহারা দেখে তাঁর কলিগরা ভেবেছিলেন আজাদের একার রোজগারে সংসারটা চলবে না। সে টঙ্গিতে চাকরি করছে করুক, বরং মিলনকে মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি দিয়ে দিই।
কিন্তু আমি তখন মাত্র এসএসসি দিয়েছি। বয়স কম। এই বয়সী ছেলেকে কি চাকরি দেওয়া যায়!
কেউ কেউ বললেন, রোড ইনস্পেক্টরের চাকরি হলে ভালো হয়। কাজের চাপ কম, উপরি পয়সা-টয়সাও আছে। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে কলেজের পড়াটা চালিয়ে যেতে পারবে।
কিন্তু বয়সের কারণে চাকরিটা আমার হলো না। হলো আজাদদার। তবে রোড ইনস্পেক্টরের চাকরি না। কেরানির চাকরি।
এসব বাহাত্তরের শেষ কিংবা তিয়াত্তরের প্রথম দিককার কথা।
চাকরিতে ঢুকেই মিউনিসিপ্যালিটির ভেতরকার রহস্য বুঝতে শুরু করল আজাদ। শুধু কেরানির চাকরিতে জীবন বদলাবে না। জীবনাটা বদলাতে চাইল সে। তারপরই কন্ট্রাক্টরির আইডিয়া এসেছিল তার মাথায়। দ্রুত জীবন বদলাবার জন্য, টাকা-পয়সার মালিক হয়ে ওঠার জন্য কন্ট্রাক্টরি হচ্ছে সবচাইতে সহজ পথ। সেই সহজ পথটা সে ধরে ফেলল।
কিন্তু নিজে মিউনিসিপ্যালিটির কর্মচারী হয়ে সে তো আর নিজের নামে কন্ট্রাক্টরিটা করতে পারে না। কাজে লাগাল আমাকে। ‘মিলন ট্রেডিং কোম্পানি’ নামে একটা কন্ট্রাক্টরি লাইসেন্স বের করল। এক বন্ধুর মার কাছ থেকে ছ হাজার টাকা ধার নিয়ে আমাকে দিয়ে শুরু করল কন্ট্রাক্টরি। আমার সেই সময়কার দীর্ঘ জীবনবৃত্তান্ত আপাতত থাক।
তারপর জীবনের জল নানাদিকে গড়িয়ে গেছে আমাদের। অভাব এবং দুঃখ-বেদনা কাটিয়ে আস্তে-ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছি আমরা। সংসারের চেহারা ঘুরছে, সচ্ছলতা আসছে। দিন পুরোপুরিই বদলাতে শুরু করেছে। আমি মশগুল হয়ে গেছি এক বালিকার প্রেমে।
জীবনের সঙ্গে সঙ্গে নামটাও যেন কেমন কেমন করে বদলাতে শুরু করেছিল আজাদের। কোন ফাঁকে কেমন করে যেন আজাদ হয়ে গেল শহীদ। তার বন্ধুবান্ধব, চারপাশের মুরব্বিজন সবাইকেই দেখি শহীদ বলে ডাকে। এমনকি পুনুআম্মাও তাকে আর আজাদ বলে না, মার মুখেও দুয়েকবার শুনেছি শহীদ। সাধারণ মানুষজনরা বলে শহীদসাব। আমার ভাইবোনরা কথা বলার সময়ও প্রায়ই দাদা বলতে ভুলে যাই। দূরের মানুষের মতো বলি শহীদসাব।
আজাদের সঙ্গে রউফ মামা মোতালেব মামার খুবই খাতির। তারা শহীদসাব বলতে অজ্ঞান। সাহায্য-টাহায্যর জন্য প্রায়ই শহীদসাবের কাছে আসে, বিশেষ করে মোতালেব মামা। এটা-ওটা নানা ছুতায় আমার ভাইর কাছ থেকে টাকা সে খসাচ্ছেই। বয়সে আজাদের চে’ বছর দুয়েকের বড় হবে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমাদের কাউকেই দুচোক্ষে দেখতে পারে না সে। বিক্রমপুরের লোক কাউকে অপছন্দ করলে কিংবা দেখতে না পারলে বলে, অরে আমি দুই চোক্কের নিলায় দেখতে পারি না।
‘নিলায়’ শব্দটার কী অর্থ আমি জানি না। দুই চোক্ষে দেখতে না পারার সঙ্গে কেন এই শব্দটা যুক্ত হয়, কী কারণে, জানি না। তবে মোতালেব মামা সত্যি সত্যি দুচোক্ষের নিলায় আমাদের কাউকে দেখতে পারত না। অযথা গালাগাল করত, ঝগড়াঝাঁটি করত। সারাক্ষণ পিসপিস পিসপিস, অর্থাৎ আমাদের সবার ওপরই সে বিরক্ত। আর হিংসা ছিল পেটভরা। যে কারও যে কোনো কিছুতেই তার হিংসা।
আমাকে আর আজাদকে খাইগ (খানদের) বাড়ির ছেলেরা খুব পছন্দ করত। আতিক নোনা ওরা ছিল আজাদের বন্ধু। বিকেলবেলা আমরা একবার খাইগ বাড়ির মাঠে গেছি। মাঠে ছুটোছুটি করে খেলা করছি আমরা। রউফ, মোতালেব, তালেব, জাহাঙ্গির, আলমগীর, ছানা, সেন্টু মিন্টু। পুরান বাড়ির কালুমামা, সৈয়দমামা, দুলাল, তাজল। ডালু তখন বেশ ছোট। ওর সেই সময়কার কথা আমার মনেই নেই। এমনকি বাদলের ওই সময়কার কথাও মনে নেই। আর ছিল কাজীবাড়ির আকবর। সেও আজাদের বন্ধু। আমাকে খুব ভালোবাসত আকবরদা।
যাহোক, আজাদ সেই বিকেলে খেলছিল না। মাঠের এক কোণে বসে আতিক, নোনা, আকবরদের সঙ্গে গল্প করছিল। তেষষ্টি-চৌষষ্টি সালের কথা। আমি আর আজাদ খুবই নিরীহ ধরনের ছেলে। কারও সঙ্গে মারামারি তো দূরের কথা, গালাগাল কিংবা দুর্ব্যবহারও আমরা করতাম না। বেশ ভীতুও ছিলাম। তো সেই বিকেলে খাইগ বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে মাঠের কোণে বসে গল্প করছে আজাদ এটা কেন যে মোতালেব মামার পছন্দ হচ্ছিল না আল্লাই জানে। ঘুরেফিরে সে ওদিকটায় যাচ্ছিল আর টুকটাক গালাগাল করছিল একবার, দুবার, তিনবার…
হঠাৎ দেখি আজাদ উঠে দাঁড়িয়েছে। ফর্সা টকটকে মুখ রাগেক্রোধে লাল হয়ে গেছে। কোনো কথা ছাড়া মোতালেব মামার নাক-মুখে
ধামাধাম ঘুষি মারতে লাগল সে। খেলা ফেলে মাঠের সবাই স্তম্ভিত হয়ে আছে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে দৃশ্যটি। কারও যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না এমন একটা ঘটনা ঘটতে পারে। আজাদের মতন নিরীহ ছেলে এই কাণ্ড করতে পারে। ফলে কেউ আর এগিয়ে গিয়ে ধরছে না তাকে, থামাচ্ছে না।
মোটমাট পাঁচ-সাতটা ঘুষি বোধহয় আজাদ মারল। সেই ঘুষি খেতে খেতে ঢ্যাঙা মতন মোতালেব মামা আমাদের চোখের সামনে ঘুরতে ঘুরতে মাঠের ঘাসে কাত হয়ে পড়ল। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, মুখের ভেতরটা রক্তে রক্তে একাকার। থু করে থুতু ফেলল। আমরা অবাক হয়ে দেখি ছ্যাপ আর রক্তের সঙ্গে কদুবিচির মতো দুখানা দাঁতও পড়েছে মাঠের সবুজ ঘাসে।
বিক্রমপুর অঞ্চলে কেউ কারও ওপর রেগে গেলে কিংবা মারধোর দিতে চাইলে বলে, দাত হালাইয়া দিমু। অর্থাৎ দাঁত ফেলে দেব। কিন্তু সত্যি সত্যি যে মেরে কেউ কারও দাঁত ফেলে দিতে পারে সেই প্রথম এবং শেষ দেখা আমার। একটি নিরীহ ভীতু ধরনের কিশোরকে ওভাবে জ্বলে উঠতে আমি আর কখনই দেখিনি।
কিন্তু মোতালেব মামার কানে যে পিঁপড়া ঢুকে গিয়েছিল…
ডালু বলল, মিলনদা!
হ্যাঁ বল।
কাজির পাগলা স্কুলের তো একশ বচ্ছর হইছে, এর লেইগা একটা অনুষ্ঠান হইব। আপনে যে এই স্কুলে পড়তেন এইটা অনেকে জানে। এইসব নিয়া এর মইধ্যে একটা মিটিং হইছে। একটা কমিটিও হইছে। সবাই চাইতাছে আপনে ওই কমিটিতে থাকেন।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে মেদিনী মণ্ডল গার্লস কলেজের কথা। কলেজটি অনেকদিন ধরে বন্ধ, নানারকম সমস্যায় জর্জরিত। বহু রকমভাবে কলেজটি চালু করার চেষ্টা করা হয়েছে, কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত এলাকার সাত-আটজন জাপান-ফেরত যুবক এবং মধ্যবয়সী মানুষ এসেছিলেন আমার কাছে। তাঁরা একটা উদযোগ নিয়েছিলেন কলেজটি চালু করার। আমি জড়িয়ে গিয়েছিলাম তাদের সঙ্গে। মনীন্দ্র ঠাকুরের যে-বাড়ি আমার ছেলেবেলার অনেকখানি জুড়ে সেই বাড়িতে হয়েছে কলেজ, 888sport app-মাওয়া সড়কের পাশে, এই কলেজ কিছুতেই বন্ধ হতে পারে না। ডিসিকে নিয়ে, এলাকার ময়মুরব্বিদের নিয়ে বেশ কয়েকটি মিটিং করলাম। মিটিংয়ে দেখি কলেজটির জন্য সবারই যেন জান একেবারে বেরিয়ে যাচ্ছে, অনলবর্ষী বক্তার আর অভাব নেই। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো প্রথমে কলেজটিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা শিক্ষা বোর্ডের তালিকাভুক্ত করতে হবে। এই কাজের দায়িত্ব নিয়ে নিলেন জাপান-ফেরতিরা। আমার অফিসে একদিন মিটিং করলেন তাঁরা। প্রাথমিকভাবে সাত হাজার টাকা দরকার। সিদ্ধান্ত হলো প্রত্যেকে পাঁচশ করে টাকা দিয়ে অমুক তারিখে কাজটা করা হবে। কাল থেকেই যে যখন পারে এসে পাঁচশ করে টাকা আমার কাছে জমা দিয়ে যাবে। আগামী সপ্তাহে বন্ধ কলেজের প্রিন্সিপালের চার্জে যিনি আছেন তিনি এসে টাকা জমা দিয়ে কাজটা শুরু করবেন।
কিন্তু একদিন যায়, দুদিন যায় জাপান-ফেরতিরা আর আসেন না। নির্দিষ্ট দিনে প্রিন্সিপালের চার্জে যে-শিক্ষিকা তিনি এসে হাজির। মেদিনী মণ্ডল থেকে সরাসরি এসেছেন আমার অফিসে। আমি হতভম্ব। টাকা পয়সার ব্যবস্থা তো হয়নি। পাঁচশ টাকা করে দেওয়া তো দূরের কথা, কেউ একবার ফোন করে খবরটা পর্যন্ত নেয়নি।
কী করি?
আমার পকেট থেকে সাত হাজার টাকা দিয়ে, ব্যাংক ড্রাফট করিয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। তারপর বছর দেড়েক কেটে গেছে, জাপান-ফেরতিরা কেউ আর আমার ছায়া মাড়ায়নি। এইসব কারণে এলাকার কোনো কিছুতে আমি আর জড়াতে চাই না। সাত হাজার টাকার শোকে না, বিরক্তিতে।
কথাটা ডালু জানে। তবু তাকে বললাম। শুনে ডালু বলল, ওইটা আর এইটা এক ব্যাপার না।
তুই কি মনে করচ আমার থাকন উচিত?
হ, মনে করি। আপনের থাকন উচিত।
ঠিক আছে, আমি আছি।
পরে বুঝেছি, জীবনে যেসব 888sport app download for androidীয় দিন এসেছে, যেসব আনন্দের সময় এবং প্রিয়জনদের ছুঁয়ে থাকার দিন এসেছে তার সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে কাজির পাগলা হাইস্কুলের শতবর্ষ উদযাপনের দিনগুলো। এত আনন্দ আর ভালোলাগার দিন বুঝি এই জীবনে কখনও আসেনি, আর কখনও আসবে না।
কিন্তু সেই যে সেই রাতে আমাদের বড়ঘরের বারান্দায় জ্বিন ডেকেছেন সেজাল খাঁ ফকির, ঘুটঘুটে অন্ধকারে জ্বিন এসে ঢুকেছে ঘরে, আমাদের যাচ্ছে এক ঘোরতর নিদানের কাল, পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় আব্বা মাত্র জ্বিনদের সঙ্গে কথা বলবেন, তার আগেই উসপিস উসপিস শুরু করল মোতালেব মামা। জ্বিনদেরকে বাবা বলার নিয়ম, আব্বা কথা বলবার আগেই মোতালেব মামা বলল, আমার কানে পিঁপড়া ঢুইক্কা গেছে বাবা। বাইর হইতাছে না। কী করি কন তো! (চলবে)


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.