সাত
চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে কোনও রকমের কোনও বিপদ-আপদ কিংবা ঝামেলায় পড়ে গেলে, কিংবা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সেজাল খাঁকে দিয়ে জ্বিন ডাকাতেন আব্বা। আব্বার কেতাবি নাম ছিল গিয়াসউদ্দিন খান। ডাকনাম গগন। পয়শার আত্মীয়স্বজনরা ডাকত গগনা।
তো সেবারও বোধহয় মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরির ক্ষেত্রে কিছু একটা ঝামেলা আব্বার হয়েছিল। চাকরি যায় যায় অবস্থা। আমরা সবাই তখন মেদিনী মণ্ডলে। বিকেলবেলা শ্রীনগরের লঞ্চে বাড়ি ফিরেই সেজাল খাঁকে খবর দেওয়া হয়েছে, জ্বিন ডাকাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সেজাল খাঁর বাড়ি দোগাছি। তিনি আমাদের আত্মীয়। ডালুর বড়ভাই সিরাজ, আমরা ডাকতাম সেরুদা, সেরুদার শ্বশুর তিনি। আব্বার সঙ্গে বেয়াই বেয়াই সম্পর্ক। দুজনে বেশ খাতিরও ছিল। এক সিগ্রেট দুজনকে ভাগ করেও খেতে দেখেছি আমি। জ্বিন ডাকার আগে সমস্যাগুলো নিয়ে সেজাল খাঁর সঙ্গে কথা বলতেন আব্বা। জ্বিনদের মতোই গম্ভীর গলায় সেজাল খাঁ বলতেন, বাবারা আহুক। মশকিল আছান হইয়া যাইব।
মাঝে মাঝে সেজাল খাঁর গলার সঙ্গে তিন জ্বিনের একজনের গলা কেমন যেন মিলে যেত। সেই বয়সে বহুবার আমার মনে হয়েছে সেজাল খাঁ নিজেই যেন জ্বিন। যাবতীয় মুশকিলের আছান যেন তিনিও করে দিচ্ছেন। এর আগেও চাকরি একবার চলে গিয়েছিল আব্বার। তখন আমার চার-পাঁচ বছর বয়স হবে। ষাট-একষট্টি সালের কথা। সেবারও সেজাল খাঁর জ্বিনদের কল্যাণে আব্বা চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন কিনা আমার মনে নেই, তবে তখন আমরা 888sport appয়, জিন্দাবাহারের বাসায় এক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি, সেইসব 888sport sign up bonusর অনেকখানিই মনে আছে। মোতালেব মামার কানে পিঁপড়া ঢোকার ব্যাপারটি ঘটল দ্বিতীয়বার।
কিন্তু সেবার চাকরিটি আব্বার বেঁচে গেল। তবে তারও দুতিনবছর পর দ্বিতীয়বারের মতো চাকরি আব্বা ঠিকই হারিয়েছিলেন। দুতিনবছর ভয়াবহ কষ্টের পর ফিরেও পেয়েছিলেন। মজার তথ্যটি হলো, আব্বা সারাজীবন চাকরি করেছেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। দুবার চাকরি হারিয়েছেন, দুবারই কেমন কেমন করে যেন আবার ফিরে পেয়েছেন। তাঁর চাকরি হারাবার মূলে নিশ্চয় অফিসের টাকা-পয়সা এদিক-ওদিক করার ব্যাপার ছিল। উপরি রোজকার কিংবা ঘুসটুসের ব্যাপার ছিল।
কিন্তু ওসব না করে কোনও উপায়ও আব্বার ছিল না। সামান্য কেরানির চাকরিতে কটাকা বেতন। সেই বেতনে এতগুলো মানুষের সংসার কীভাবে চলে! সংসার বড় হবার কারণও তো ছিলেন আব্বা নিজেই।
কারণ সন্তান-জন্মের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই উদার নীতির মানুষ। ফলে এগারোটি ছেলেমেয়ে জন্মেছিল তাঁর। কিন্তু বিবাহিত জীবন তেমন দীর্ঘদিনের ছিল না। আঠারো-উনিশ বছর বয়সে বিয়ে করে আব্বা বেঁচে ছিলেন চুয়াল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত। দুঃখ-দারিদ্র্য-শ্রম এবং এতগুলো ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই গভীর এক উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হতো তাঁকে। তার ওপর পুনু আম্মা, রিনা এবং বুজি – এই তিনজন বাড়তি মানুষও ছিল সংসারে। এছাড়া একজন দুজন কাজের লোক, কখনও কখনও গ্রাম থেকে কাজের আশায় শহরে আসা কেউ না কেউ, মায়ের চাচাতো ভাইদের কেউ না কেউ এবং ডালুর বড়ভাইদের কেউ না কেউ আমাদের সংসারে থাকতই। সবমিলে এক বিশাল সংসার।
এগারোটি ভাইবোনের মধ্যে একটি ভাই মাত্র আঠারো দিন বেঁচে ছিল। সেটা তেষট্টি-চৌষট্টি সালের কথা। তারপর আরও দুটি ভাইবোন হয় আমার।
আঠারো দিন বয়সী ভাইটি জন্মেছিল জিন্দাবাহার থার্ডলেনের বাসায়। সেই ভাইয়ের মৃত্যুর কিছুদিন পরই আমরা বিক্রমপুরের গ্রামে নানাবাড়িতে গিয়ে কয়েকমাস থাকি। ততদিনে জিন্দাবাহারের বাসা ছেড়ে গেন্ডারিয়াতে বাসা ভাড়া নেন বাবা। কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ ভাইবোনের মতোই পরের ভাইবোন দুটিও জন্মেছিল নানাবাড়িতে। আর একটি সময়ে আমি, আজাদ এবং মণি – এই তিনজন গ্রামে বুজির কাছে থেকেছি। কখনও তিনজন একসঙ্গে, কখনও আমি একা।
গ্রামের জীবনটির কথা এখনই আর বলতে চাই না, সামান্য বলতে চাই জিন্দাবাহার থার্ডলেনের জীবনটির কথা। বহু ভাড়াটেঅলা একটি একতলা বাড়ি ছিল জিন্দাবাহার থার্ডলেনে। সেই বাড়ির একটি ঘরে ভাড়া থাকতাম আমরা। তখন আমরা আটটি ভাইবোন, কখনও কখনও পুনু আম্মা এবং রিনা ও কাজের আশায় এসে থাকে কোনও কোনও মামা, সৎ খালাতো ভাইয়েরা, বাবার দুজন সৎ ভাইয়ের কেউ না কেউ। এমনকি নানাবাড়ির দিককার লতায়-পাতায় সম্পর্কিত কোনও কোনও আত্মীয়ও বাবা খুব বড় চাকুরে ভেবে তাঁর সাহায্যের আশায় আমাদের ওইটুকু একঘরের সংসারে এসে উঠত। অথচ বাবা মিউনিসিপ্যালিটির সামান্য কেরানি। তবু তাঁর কিছু পরিচয়, যোগাযোগ ছিল। আজিজ নামের একজনকে মিউনিসিপ্যালিটিতে ভূঁইমালীর চাকরি দিয়েছিলেন আব্বা। হামেদ মামাকে লিয়াকত এভিনিউর এক থান কাপড়ের দোকানে সেলসম্যানের কাজ দিয়েছিলেন। ফজল কাকা, হাপিকাকারা কেউ সদরঘাটের ফুটপাতে কাটাকাপড় বিক্রি করে, কেউ পাউরুটির দোকানদার।
আব্বা ছিলেন পরোপকারী, সৎ এবং নিরীহ ধরনের মানুষ। গ্রাম থেকে যে-ই আসত তাকে নিজের সংসারে রেখে সাহায্য-সহযোগিতার একটি প্রবণতা তাঁর ছিল। নিজে মেঝেতে শুয়ে আমার মায়ের চাচাতো ভাইদেরকে চৌকি ছেড়ে দিতে বহুবার দেখেছি আমি। অন্যের উপকার করতে গিয়ে দু দুবার মিউনিসিপ্যালিটি থেকে তাঁর চাকরি চলে যায়। একে সামান্য বেতনের কেরানির চাকরি তার ওপর অতবড় সংসার, তার ওপর চাকরি চলে যাওয়া, ইস কী যে দুঃখ-কষ্টের দিন সেসব! প্রতিদিন সকালে মাকে দেখতাম সংসারে আজ চুলো জ্বলবে কী জ্বলবে না ওই নিয়ে উৎকণ্ঠিত। আব্বাকে দেখতাম চারদিক থেকে মার খাওয়া বোবা জন্তুর মতো দিশেহারা। ক্ষুধা-দারিদ্র্য এবং উৎকণ্ঠায় গ্যাস্ট্রিক নামের একটি অসুখ তখন থেকেই তাঁর নিত্যসঙ্গী।
আব্বা প্রথম চাকরি হারালেন, ষাট-একষট্টি সালের কথা। আমি তখনও স্কুলে পড়ি না। জিন্দাবাহারে বাসা। আজাদ সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, সংসারের কোনও কাজ করছে না। একটি দিন চলার জন্য আব্বা হয়তো কোনও রকমে দুটি টাকা যোগাড় করেছেন। ওই টাকার একটি ভাঙিয়ে চারটি সিকি করা হয়েছে। একটি টাকার সঙ্গে একটি সিকি, অর্থাৎ পাঁচসিকা নিয়ে আমি চলে গেছি নয়াবাজারে চাল আনতে। চাল রেখে দুটি সিকি কিংবা একটি আধলি নিয়ে গেছি মাছ-তরকারি আনতে। তারপর আবার গেছি লাকড়ি আনতে।
তখনও গ্যাস চালু হয়নি। কেরোসিনের চুলো, পেতলের স্টোভ ছিল। কিন্তু ওই ধরনের সাহেবি চুলো কেনার সাধ্য আমাদের ছিল না। বারান্দায় মাটির আলগা চুলোয় লাকড়ি গুঁজে রান্না করতেন মা। ফুকনি বলে একটি জিনিস ছিল, সেটি আসলে লোহার একটুকরো পাইপ, চুলোয় লাকড়ি গুঁজে ফুকনি দিয়ে ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাতে হতো।
জিন্দাবাহার থার্ডলেনের জীবনটি আমার কেটেছে প্রায়দিনই তিনবার নয়াবাজারে গিয়ে। চটের ব্যাগে চার-পাঁচ সের চাল মেপে দিত দোকানদার। সেই ব্যাগের মুখ সুতলি দিয়ে বেঁধে শক্ত করে আমার মাথায় তুলে দিত। আমি বয়ে আনতাম আমাদের দুঃখী সংসারে। তারপর যেতাম মাছ-তরকারি আনতে। সবশেষে লাকড়ি। দুআনায় তখন চার-পাঁচসের লাকড়ি। কিন্তু লাকড়িগুলো আমি মাথায় করে আনতাম না। দুহাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে মেলে ধরতাম দোকানির সামনে। লাকড়িগুলো সে আমার হাতের ওপর সাজিয়ে দিত। সেভাবে লাকড়ি পাঁজাকোলে নিয়ে ফিরে আসতাম আমি। হাত দুটি যে কী ব্যথা করত, কী যে কষ্ট! লাকড়ির ভারে গভীর দাগ পড়ে যেত হাতে।
জিন্দাবাহার এলাকায় তখনও ইলেকট্রিসিটি পৌঁছায়নি। সন্ধেবেলা গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা লাইটপোস্টের মাথায় হারিকেনের মতো একখানা আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেত বাতিঅলা। তার হাতে থাকত কেরোসিনের বালতি, কাঁধে মই। মই বেয়ে উপরে উঠে আলো জ্বালাত সে। ওই সামান্য আলোয়ও বেশ আলোকিত হতো গলিটি। কিন্তু আমাদের সেই জীবনে বিন্দুমাত্র আলো ছিল না, জীবন ছিল গভীর অন্ধকারে।
বেশির ভাগ দিনই সকালে নাশতা হতো না আমাদের। তিনবার বাজার সারার পরও পেটে গভীর খিদে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতাম আমি। জিন্দাবাহারের সঙ্গেই ইসলামপুর রোড। ইসলামপুরে তখন বোম্বাইয়াদের লম্বা লম্বা কিছু থান-কাপড়ের দোকান। লোহার পাত কেটে অতিকায় কাপড়ের গাঁট ভাঙছে কর্মচারীরা। ফর্সা চেহারার মোটা মোটা মালিকরা গদিতে বসে আছে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে। টুংটাং করে বেল বাজিয়ে যায় দুএকটি রিকশা। দুপুরের নির্জনতায় গলির ভেতর হেঁকে ওঠে সোনপাপড়ি কিংবা আইসক্রিমঅলা। বিহারি বাড়ির ছেলেমেয়েরা সোনপাপড়ি কেনে, আইসক্রিম কেনে। কত না আমোদে খায়! পেটভর্তি খিদে নিয়ে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।
খিদের দিনগুলো যে কী দীর্ঘ হয়! একেকটি মুহূর্ত একেকটি ঘণ্টার মতো, কাটতেই চায় না। একতলা বাড়িটির শ্যাওলাপড়া ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। জিন্দাবাহারে তখন লোহার একখানা পানির ট্যাঙ্ক তৈরি হচ্ছে। দিনমান লোহা পেটানোর শব্দ ভেসে আসে। এই শব্দের ভেতরে এক দুপুরে ছাদে উঠে দেখি এক ভাড়াটের ন্যাংটো শিশুকন্যার ওপর কেরামতের ছোটভাই, সে-ও শিশু, ন্যাংটো হয়ে শুয়ে আছে। দৃশ্যটির অর্থ আমি বুঝতে পারিনি।
এই বাড়িতে একবার কুয়ো থেকে বালতি তোলার কাঁটা আমার পায়ে ফুটে গিয়েছিল। আরেকবার এত কৃমি হয়েছিল আমার পেটে, পেট ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল। আব্বা কষ্টমষ্ট করে পাটুয়াটুলির মোড়ের কাছে এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। আগেই কৃমির একটি সিরাপ ছআনা না আট আনা দিয়ে আব্বা আমাকে এনে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ নিজেই ডাক্তারিটি করেছিলেন। সেই সিরাপের শিশি সঙ্গে নিয়ে গেছি। কৃমির কথা বলে সিরাপটি ডাক্তারকে দেখানো হলো। আব্বা বলেছিলেন এক চামচ করে রাতে খেতে, সেই ডাক্তার বললেন, আধা শিশি একবারে খাইয়ে দিতে। সেইরাতে তা-ই করা হলো। পরদিন ভোর সকালে তলপেটের চাপে আমি আর টিকতে পারি না। দৌড়ে গিয়ে কুয়োর পাশের ড্রেনে বসে পড়লাম। তারপর সাপের বাচ্চার মতো, ওই জিনিসকে বিক্রমপুরে বলে লখাই, দলাদলা লখাই বেরুতে লাগল আমার ওই পথ দিয়ে।
কিন্তু খিদের কাছে এই সমস্ত ব্যাপার ছিল অতি তুচ্ছ। ইসলামপুরের রাস্তা পেরুলেই নোয়াববাড়ি। নোয়াববাড়ির মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন আব্বা। মসজিদের উলটোদিকে, সিঁড়ি ভেঙে অনেকখানি উঠে যাওয়ার পর অজুখানা। বিশাল একখানা হাউজের চারপাশে নামাজি মানুষ যাতে বসে আরামসে অজু করতে পারেন সেই ব্যবস্থা। সেখানে বসে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য অজু করতে দেখেছি আব্বাকে। আর দেখেছি হাউজের ভেতর চড়ে বেড়াচ্ছে অজস্র লাল-নীল সাদা-কালো মাছ। কী নাম ছিল সেইসব মাছের জানা হয়নি কখনও।
নোয়াববাড়ির মাঠে ফুটবল ক্রিকেট খেলত এক ধরনের ফুটফুটে ছেলে। তাদের দেখে মনে হতো, বহুদূরের, অন্য এক জগতের মানুষ তারা। যে-জগতে টাকা-পয়সার কোনও অভাব নেই, খাদ্যের কোনও অভাব নেই। পেটভর্তি খিদে নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ত আমার। নোয়াববাড়ি ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীতীরে চলে যেতাম। বুড়িগঙ্গা তখন অনেকখানি চওড়া, গভীর। তীরের বেলে মাটিতে সিঁড়ি ফেলে দাঁড়িয়ে থাকত ছোট-বড় লঞ্চ। বজরার মতো এক ধরনের নৌকায় ছিল হিন্দু হোটেল। সেইসব হোটেল থেকে কতলোক পেটপুরে খেয়ে বেরুত। আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের দেখেছি।
জিন্দাবাহারের গলিভর্তি ছিল প্রেস। ঘটর ঘটর করে প্রেস চলছে। সিসের তৈরি টাইপ বাক্স থেকে তুলে কম্পোজ করে যাচ্ছে কম্পোজিটররা। এইসব প্রেসের আশেপাশে ঘুরঘুর করত আমার বয়সী দরিদ্র শিশুরা। প্রেস ঝাড় দেওয়া দুচারটি টাইপ পড়ে থাকত ইতিউতি, সেসব কুড়াত। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমিও কুড়িয়েছি। তারপর সেই টাইপ জড়ো করে, লোহার খেলনা কড়াইয়ের তলায় আগুন দিয়ে গলিয়েছি। এই করে করে একদিন বেশ কিছুটা সিসে জমলে কটকটিঅলাদের কাছে বেচে দিতাম। একআনা, দুআনা এমনকি তিন-চারআনাও পেয়েছি কখনও কখনও। কী যে মূল্য ছিল সেই পয়সার!
কটকটিঅলাদের দুধরনের নিয়ম ছিল। একেবারেই অপ্রয়োজনীয় শিশি-বোতল ভাঙার বিনিময়ে পয়সা দিত না তারা, দিত কটকটি। কটকটি জিনিসটা এক ধরনের পচা গুড়ের ফেনা দিয়ে তৈরি। অতি অখাদ্য। সেইসব অভাবের দিনে একটুখানি কটকটিও যে কী মূল্যবান ছিল!
আর মূল্যবান জিনিস নগদ পয়সা দিয়ে কিনে নিত কটকটিঅলারা। যেমন সিসা কিংবা ভাঙাচোরা তামা পেতল কিংবা অ্যালুমিনিয়াম।
এসময় একদিন দুপুর পেরিয়ে গেছে, আমাদের সংসারে সেদিন রান্না হয়নি, আমি আর আজাদ লায়ন সিনেমা হলের ওদিককার
রাস্তায় পেটভর্তি খিদে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেখি রাস্তার ধারের একটি বাড়িতে মেজবানি হচ্ছে। লাইন ধরে খেতে ঢুকছে লোকজন। পোলাও-মাংস, জর্দা-ফিরনির গন্ধে ম ম করছে চারপাশের হাওয়া। হাঁটতে হাঁটতে আমরা দুজন গিয়ে দাঁড়িয়েছি সেই বাড়িটির সামনে। দেখি আমাদের বয়সী দীনদরিদ্র ধরনের ছেলেমেয়েরাও ঢুকছে। আজাদ বলল, চল, আমরাও ঢুকি। আমার কেমন ভয় ভয় করছিল। তবু খাবারের গন্ধে এবং খিদেয় দিশেহারা হয়ে সেইসব দীনদরিদ্র ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমরা দুজনও ঢুকে গেলাম। মনে আছে একজন লোক আমাদের দুভাইয়ের মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে কী দেখল কে জানে, কিন্তু পথের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদেরকে বসাল না। আমাদের দুজনকে নিয়ে গেল ভেতর-দিককার একটি ঘরে। সেই ঘরে কেউ খাচ্ছে না কিন্তু হাঁড়িপাতিল ভর্তি খাবার। মোটা মতন গৃহকর্ত্রী টাইপের একজন মহিলা সেইসব খাবার আগলে বসে আছেন। লোকটি উর্দুতে সেই মহিলাকে কী কী বলল, মহিলা গভীর মায়াবী চোখে আমাদের দুভাইয়ের দিকে তাকাল। তারপর অতিযত্নে নিজের সামনে বসিয়ে পোলাও, বড় বড় মাংসের টুকরো, ফিরনি খাওয়াল। পরিমাণে এত বেশি ছিল সেইসব খাবার, খেতে বসে আমার শুধু 888sport app ভাইবোনের কথা মনে পড়ছিল। মা-আব্বার কথা মনে পড়ছিল। আহা সবাই মিলে যদি এইসব খাবার খাওয়া যেত! আমরা দুটি ভাই এত ভালো খাবার খাচ্ছি আর মাত্র একটি গলির পর আমাদের একঘরের সংসারে না খেয়ে আছে ছোট ছোট ভাইবোনগুলো, আমার মা। দু-পাঁচটি টাকা যোগাড়ের আশায় অনাহারী আব্বা ঘুরে বেড়াচ্ছেন কোথায় কোথায়!
আমাদের জিন্দাবাহারের জীবন মানেই এ-সমস্ত দিন। কবে আব্বা তার চাকরি ফিরে পাবেন, কবে আমাদের দুঃসময় কেটে যাবে, কবে আসবে সুসময় সেই আশায় দিন গোনা।
আব্বা তার চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন বছরখানেক পর।
তো সেবার আব্বা প্রায় চাকরি হারাতে বসেছেন, গভীর উৎকণ্ঠায় জ্বিন ডেকেছেন সেজাল খাঁ, কোথায় আব্বা নিদানের কথা বলবেন, মোতালেব মামা আচমকা বললেন তার কানে পিঁপড়া ঢুকে যাওয়ার কথা। ইস আমরা যে কী বিরক্ত হলাম। বুজি চাপা রাগী গলায় তাকে একটি ধমক দিলেন। এই তুই চুপ কর। খোকার বাপরে কথা কইতে দে।
তারপর কখন কীভাবে মোতালেব মামার কানের পিঁপড়া বেরুল সে-কথা আমার আর মনে নেই। তবে আব্বার চাকরিটি সেবার বেঁচে গেল।
দ্বিতীয়বার আব্বা চাকরি হারান আটষট্টি সালে। আমরা তখন গেন্ডারিয়ার মুরগিটোলা নামের একটি এলাকায় থাকি। বাড়ির পেছনে বিশাল একখানা পুকুর। বুজি তখন 888sport appয়, ওই বাড়িতে। আব্বার চাকরি চলে যাওয়ার কথা শুনে মাথা খারাপ হয়ে গেল তাঁর। বদ্ধ পাগল হয়ে গেলেন। আব্বাকে আপন ছেলে মনে করতেন তিনি। ডাকতেন ‘খোকার বাপ’ বলে। আমার পাগল বুজি তখন সারাদিন ‘পানির তল, পানির তল’ বলে বিলাপ করেন আর বাড়ির পেছনদিককার পুকুরে নেমে বসে থাকেন। এই পুকুরে ডুবেই একদিন মারা গেলেন তিনি। আমি তখন মুন্সিগঞ্জের ওদিককার বেসনাল নামের গ্রামে মালেক কাকাদের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে বুজির মৃত্যুসংবাদ শুনে যতটা না কেঁদেছিলাম, কী যেন কী কারণে কেঁপেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি। কেন যে ঠক ঠক করে অত কাঁপছিলাম, সেই রহস্য আজও জানি না।
দ্বিতীয়বার চাকরি ফিরে পেতে আড়াই-পৌনে তিনবছর লেগে গেল আব্বার। আমরা তখন নিয়মিত ভাড়া দিতে না পারার কারণে দু-তিনমাস পর পরই বাড়ি বদল করছি। আব্বা নানা ধরনের কাজ করে, ছাত্র পড়িয়ে রোজগারের চেষ্টা করেছেন। আমি এবং আজাদ আব্বার পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি। ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকেই টিউশনি করছি আমি। কোনও টিউশনিতেই মাসে দশটাকার বেশি পাই না। ওই দশটি টাকা নিয়েও কেউ কেউ আবার বেশ ঘোরায়। পড়াতে গেলে এককাপ চা-ও খাওয়ায় না। কিন্তু আমার খুব খিদে পেত।
আজাদও টিউশনি করছিল। জগন্নাথ কলেজে নাইটে আইকম পড়ে সে। এই অবস্থায় টঙ্গিতে একটি চাকরি হলো তার। সকালবেলা টঙ্গি গিয়ে ফেরে রাতের বেলা। কলেজ করা হয় না। তবু সংসার সামান্য সচ্ছল হচ্ছে।
এসব সত্তরের মাঝামাঝির কথা। আমি ক্লাস টেনে উঠেছি। গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে পড়ি। ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হই বলে স্যাররা খুব ভালোবাসেন। স্কুলে বেতন দিতে হয় না। মনে আছে আমার এসএসসি পরীক্ষার ফি সব মিলিয়ে ষাট না সত্তর টাকা দিয়েছিলেন আমাদের ইংরেজির টিচার রউফ স্যার।
এসবের কিছুদিন পর আব্বা তাঁর চাকরি ফিরে পেলেন। যতদিন চাকরি ছিল না ততদিনের বেতনও পেলেন এককালীন। কিন্তু সেই টাকা চোখের নিমিষে উধাও হয়ে গেল। কারণ দু-আড়াই বছরে প্রচুর ধারদেনা হয়েছিল। একটি সময়ে পাওনাদারদের ভয়ে দিনের পর দিন বাড়ি ফিরতেন না আব্বা। কোনও কোনও গভীর রাতে ফিরে মায়ের হাতে সামান্য টাকা-পয়সা গুঁজে দিয়ে ভোররাতে আবার বেরিয়ে যেতেন। কারণ দিনের আলো ফুটলেই পাওনাদাররা এসে হাজির হবে।
এককালীন টাকা পেয়ে বেশির ভাগ ধারদেনা শোধ করে দিলেন আব্বা, শুধু একজন খানসাহেবের মানে কাবলিঅলার টাকা রয়ে গেল। আটষট্টি-উনসত্তর সালে গেন্ডারিয়া পোস্টঅফিসের গলির একতলা একটি বাড়িতে কিছু কাবলিঅলা থাকত। তারা সুদে টাকা খাটাবার কাজ করত। আব্বা কেমন কেমন করে যেন তাদের একজনের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়েছিলেন। মাসে দশ না বিশ টাকা যেন সুদ দিল, কিন্তু সেই টাকাটা কখনই নিয়মিত দেওয়া হতো না। মুরগিটোলার বাসায় প্রায়ই কাবলিটা আসত। তারপর আমরা বিভিন্ন বাসা বদলাচ্ছি, কাবলিটাও কেমন কেমন করে সেইসব বাসার হদিস বের করে ঠিক হাজির হচ্ছে। সুদে-আসলে তার টাকা তখন অনেক দাঁড়িয়েছে। প্রতিবার এলেই কোনও না কোনওভাবে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাকে আব্বা বিদেয় করতেন।
কিন্তু চাকরি ফিরে পাওয়ার পর, এককালীন বেতনের টাকা পাওয়ার পর সেই কাবলিটার আর কোনও হদিস আমরা পেলাম না। বেশ অনেকদিন ধরেই সে আর আসছিল না। দেশে তার আগে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেছে। সত্তরের নির্বাচন হয়ে গেছে। দেশ পেরুচ্ছে এক উত্তাল সময়। সম্ভবত এইসব কারণেই কাবলিটা উধাও হয়ে গেছে। তারা যে-বাড়িটায় থাকত সেই বাড়িটা ফাঁকা। স্কুল থেকে ফেরার পথে আমি একদিন খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম।
আব্বা ততদিনে নতুন উদ্যমে পুরনো চাকরি শুরু করেছেন। আমরা থাকি গেন্ডারিয়ার সাবেক শরাফতগঞ্জ লেনে। একটি দোতলা বাড়ির নিচের তলার পেছনি দিকটায়। ছোট্ট একটি কানাগলি দিয়ে ঢুকে আমাদের গেট। বড় রুমটায় একটি জানালা আছে গলির পাশে। সেই জানালা দিয়ে তাকালে ওপাশের দোতলা বাড়িগুলো দেখা যায়। একটি বাড়ির দোতলা রেলিংয়ে ফুটফুটে এক কিশোরী আমাকে জানালায় দেখলেই ছুটে আসত, উৎফুল্ল হতো। মিষ্টি করে হাসত। বোধহয় আমাকে তার ভালো লেগেছিল।
এই বাড়িতেই পঁচিশে মার্চের কালোরাত কাটিয়েছিলাম আমরা। বিধ্বস্ত সংসার সামলাতে গিয়ে আব্বা এবং আমরা সবাই এতটাই কাহিল, দেশের খোঁজখবর রাখার সময় নেই। আমি তখনও টিউশনি করি। আজাদ টঙ্গিতে চাকরি করে। আমাদের রেডিও-টেলিভিশন কিচ্ছু ছিল না। খবরের কাগজ কেনার বিলাসিতা কোত্থেকে করব!
আব্বার ততদিনে স্বাস্থ্য খুব ভেঙেছে। গ্যাস্ট্রিক থেকে আলসার হয়েছে পাকস্থলীতে। এই অসুকে যে-ধরনের খাবার এবং ওষুধ দরকার সেসব যোগাড় করা সম্ভব নয়। ফলে অতিসস্তা একটি ওষুধ কে জানে কার পরামর্শে বেশ কিছুদিন ধরেই খেতে শুরু করেছিলেন তিনি। আব্বার মুখে শুনতাম ‘সোডিমিনকার্ম’ বা এই জাতীয় একটি নাম ওষুধটার। জিনিসটি আমাদের পাড়ার কাশেমের মুদি দোকানেও পাওয়া যেত। ধবধবে সাদা এক ধরনের পাউডার। লোক বলত খাবার সোডা। এই খাবার সোডা তাৎক্ষণিকভাবে আলসারের ব্যথা কমিয়ে দিত। ব্যথা উঠলেই আব্বাকে দেখতাম এক বা দুআনা দিয়ে এক পুড়িয়া খাবার সোডা কিনে আনাচ্ছেন। আমরাই কোনও না কোনও ভাইবোন গিয়ে কিনে আনতাম। ওই জিনিস মুখে ফেলে ঢক ঢক করে একগ্লাস পানি খেতেন আব্বা। সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা কমত তাঁর, কিন্তু মাকে দেখতাম ওই নিয়ে মুখ ঝামটাচ্ছেন। কারণ মা নাকি জেনেছেন এই সোডা আসলে এক ধরনের বিষ। নিয়মিত খেলে পাকস্থলী পচে যায়। আব্বা যে কেন খাচ্ছেন!
মায়ের কথায় পাত্তা দিতেন না আব্বা। নিঃশব্দে খদ্দরের জীর্ণ পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে যেতেন। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে লক্ষ্মীবাজারের ওদিককার নাসিম নামে একটি পাকিস্তানি ছেলেকে বাংলা শেখাতেন তিনি। মাসে বোধহয় বিশ-পঁচিশ টাকা পেতেন।
ততদিনে পাকিস্তানিরা তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে শুরু করেছে। শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় মানুষ চলে যাচ্ছে গ্রামে। সংগঠিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ।
কিন্তু আমরা কোথায় যাব? কে আছে আমাদের? এতগুলো মানুষ আমরা এমনিতেই প্রতিদিন এক ধরনের যুদ্ধ করছি পেটের আহার জোটাবার জন্য। তার ওপর দেশ বাঁচাবার জন্য শুরু হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার সাধ্য আমার কিংবা আজাদের নেই। কারণ আমরা যুদ্ধে গেলে আব্বার পাশে দাঁড়িয়ে ছোট ভাইবোনগুলোকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখবে কে? শরাফতগঞ্জ লেনের সেই বাড়িতেই রয়ে গেলাম আমরা। কী যেন কী কারণে আমি হঠাৎ ন্যাড়া হয়ে গেলাম। [চলবে]


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.