সিদ্ধার্থের সিদ্ধিলাভ

মঞ্চে একটা নতুন নাটক আসা মানেই দর্শকদের মাঝে একটা উৎসবের আমেজ তৈরি হওয়া। আর সেই নতুন নাটক দেখতে যাওয়ার অনুভূতিটাই আলাদা। তারপরে তা যদি হয় আরশিনগরের মতো একটি প্রতিশ্রুতিশীল দলের নাটক, তাহলে সে-অনুভূতিটা আরো ভিন্নমাত্রার হয়। আরশিনগর এর আগেই তাদের প্রযোজনা সে রাতে পূর্ণিমা ছিল ও রহু চণ্ডালের হাড় নাটক দুটি দিয়ে তাদের প্রযোজনা নৈপুণ্যমানের প্রমাণ দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। আর এসব নাটকের নির্দেশক রেজা আরিফ তাঁর দল আরশিনগরের বাইরে তাঁর বিভাগের (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ) ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আলকেমিস্ট, মাদার কারেজ অ্যান্ড হার চিলড্রেনস, কারবালার জারি প্রভৃতি নাটকের মাধ্যমে নিজেকে একজন দক্ষ নির্দেশক হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন ইতঃপূর্বেই। তাই আরশিনগরের নতুন নাটক সিদ্ধার্থ নিয়ে আগাম আগ্রহ-উত্তেজনার ডালপালা বিস্তার লাভ করবে এটাই স্বাভাবিক। দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণে আরশিনগর কতটা সফল হলো সেটাই বিবেচ্য।

সিদ্ধার্থ জার্মান লেখক হেরমান হেসের বিখ্যাত একটি 888sport alternative link। জাফর আলমের 888sport app download apk latest version থেকে নাটকটির নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন রেজা আরিফ। সিদ্ধার্থ 888sport alternative link ১৯২২ সালে লেখা। ১৯২৯ সালে বাংলায় লেখা হয়েছিল জগদীশ গুপ্তের অসাধু সিদ্ধার্থ। কাছাকাছি সময়ে লেখা এবং নামে অনেকাংশে   মিল থাকলেও এই দুই সিদ্ধার্থের মাঝে মিল খুঁজতে যাওয়া ঠিক হবে না। আবার একথাও অবশ্য বলে রাখা ভালো, যে-সিদ্ধার্থকে আমরা বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধ হিসেবে জানি, সেই সিদ্ধার্থ আর হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ এক নন। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত থাকলে আর সমস্যা হতো না। কিন্তু সমস্যাটা এখানে যে, উভয় সিদ্ধার্থই একই সময়ের এবং কখনো কখনো উভয় সিদ্ধার্থই যেন জীবনচর্চায়, দর্শনচর্চায় একই পথের যাত্রী, আবার কখনোবা উল্টোপথের। এই ধন্দ কাটাতে নাট্যকার অবশ্য একটা ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন – ‘গৌতম বুদ্ধের ঔজ্জ্বল্যে আড়াল হয়ে পড়া গৌতমের ব্যক্তিগত মনোজগতের রঙে সিদ্ধার্থকে আঁকা হয়েছে।’ একথা তো সত্যি, কেউ যখন তাঁর কালের অন্য সকলকে ছাড়িয়ে মহীরুহে পরিণত হন, তখন তাঁকে নিয়ে নানারকম ন্যারেটিভ তৈরি হয়। গৌতম বুদ্ধকে নিয়েও ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছিল তাঁর সময় থেকেই। সেসব ন্যারেটিভ বিবেচনায় না নিয়ে হেরমান হেসের 888sport alternative linkের নাট্যরূপ সিদ্ধার্থই আমাদের বিবেচ্য হওয়া উচিত।

সিদ্ধার্থ এক অসাধারণ সৃষ্টি। কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে লেখক গুঁজে দিয়েছেন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র-জীবন-দর্শন-জ্ঞানের আকর। কাব্যগুণসমৃদ্ধ এ-রচনায় ভারতীয় বৈচিত্র্যময় দর্শনের প্রেক্ষাপটে আত্মানুসন্ধানের আধ্যাত্মিকত্ববাদী এক পরি888sport slot gameকে রূপায়ণ করা হয়েছে অনন্য শৈল্পিক মহিমায়। মঞ্চে এর উপস্থাপন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত জটিল ও শ্রমসাধ্য। ২০০৩ সালে
বৌদ্ধদর্শন-ইতিহাস ও অতীশ দীপঙ্করের জীবনীর সমন্বয়ে অতীশ দীপঙ্কর সপর্যা নামে একটি নাটক মঞ্চায়নকালে বিষয়টি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল বর্তমান নিবন্ধকার। ফলে সিদ্ধার্থর মঞ্চ-উপস্থাপন নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল নিবন্ধকারের।

আমাদের মঞ্চে 888sport app থিয়েটারের অনুসরণে অনেক দলই বর্ণনাত্মক নাটক উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন বা করেন। সেসব নাটকের বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত আর নাটক হয়ে ওঠে না। অভিনেতারা শুধু কথা বলে কোনো একটা ঘটনার বা বিষয়ের বর্ণনা করার চেষ্টা করেন মাত্র, যা দর্শকদের কানকে কিংবা কল্পনাকে আকৃষ্ট কিংবা প্রভাবিত করতে পারে না। তাতে নান্দনিক উপস্থাপনের চরম দুর্দশা লক্ষ করা যায়। শুধু কথা বলেও যে থিয়েটার হতে পারে, তার প্রমাণও তো রয়েছে। অনেক বছর আগে ১৯৯৯ সালে আইটিআই 888sport apps কেন্দ্র আয়োজিত এক উৎসবে সুইডিশ নাট্যদল এল্লেনা (অষষবহধ) এসেছিল 888sport appয়। তারা ম্যাকবেথ নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন গাইড হাউস মিলনায়তনে। নির্দেশক ছিলেন লার্স একারলান্ড (খধৎং অশবৎষঁহফ)। সম্ভবত তিনিই ছিলেন এ-নাটকের একক অভিনেতা। কী অসাধারণ দক্ষতায় তিনি একা একা অভিনয় করেছিলেন। কোনো আলোর খেলা ছিল না, আবহসংগীতের ব্যবহার ছিল না। তিনি মঞ্চে শুধু একটা সাধারণ চেয়ার, টেবিল, একটা প্লেট, প্লেটে এক টুকরো কেক, একটা কাঁটা চামচ, একটা চাকু-চামচ আর একটা কোকের বোতল ব্যবহার করেছিলেন। এসব যৎসামান্য প্রপস ব্যবহার করে কী দুর্দান্ত পারফরম্যান্সই না করেছিলেন সেই অভিনেতা। এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে সেই নাটকের 888sport sign up bonus। একইভাবে বলা যেতে পারে শম্ভু মিত্রের কথা। শেষ জীবনে এসে মঞ্চে তিনি একা একা পাঠ করতেন তাঁর চাঁদ বণিকের পালা নাটকটি। শুধু কথা বলেও নাটক হতে পারে। তবে তাতে নির্দেশক ও অভিনেতার সুউচ্চমানের দক্ষতা থাকতে হয়। স্বীকার করতে গ্লানি নেই যে, আমাদের মঞ্চে তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই বলে কি আমাদের মঞ্চে ভালো অভিনেতা নেই? নিশ্চয়ই আছে। নাটকে পেশাদারিত্বের অভাবে অনেক ভালো অভিনেতাকে ব্যস্ত থাকতে হয় অন্য পেশায়। তারপরও ভালো নাটক হয় না এমন নয়। অবশ্যই হয়। অত্যন্ত উচ্চমানের প্রযোজনাও হয় সাধারণ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সমভিব্যহারে। সেক্ষেত্রে নির্দেশকদের অনেক স্ট্র্যাটেজিক হতে হয়। রিসোর্সের সর্বোচ্চ ব্যবহারে মনোযোগী হতে হয়। কৌশল করে 888sport live chatনির্মাণে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত আবৃত্তি888sport live chatী প্রদীপ ঘোষ নিবন্ধকারকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার গুরু সব্যসাচীর কণ্ঠ ছিল একতাল সোনা। আর আমার কণ্ঠ সেই অর্থে এক রত্তি সোনা। আমার তো তাঁর পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতা নাই। তাহলে আমার করণীয় কী? আমি তখন আমার এক রত্তি সোনাকে পিটিয়ে পিটিয়ে এমনভাবে অলংকরণ করার চেষ্টা করলাম, যা অন্যদের দৃষ্টি কাড়তে পারে। তাতে কাজ হলো।’ রেজা আরিফ সেই কাজটি করেছেন। তাঁর টিমের অভিনেতৃবর্গের কেউ কেউ নবিস, আবার কেউ কেউ বেশ দক্ষ। অর্থাৎ বিভিন্ন মানের 888sport live chatী ছিলেন তাঁর টিমে। তিনি টিমকে এমনভাবে অলংকরণ করেলেন বা সাজালেন কিংবা বলা যায় তৈরি করলেন, যাতে অভিজ্ঞের সঙ্গে অনভিজ্ঞের ফারাকটা চোখে না পড়ে। কোথাও দুর্বলতা যাতে প্রকট হয়ে না ওঠে সেজন্য তিনি সমতাভিত্তিক বিন্যাসকে প্রাধান্য দিয়ে একটা শক্তিশালী টিমনির্ভর প্রযোজনা নির্মাণ করলেন। 

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধার্থ নাটকটিকে রেজা আরিফ বেঁধেছেন অসামান্য কুশলতায়। তিনি গল্প বলে গেছেন দার্ঢ্যভঙ্গিতে। সিদ্ধার্থের জীবনের চারটি পর্বকে উপস্থাপন করা হয়েছে এ-নাটকে। কখনোই কোনো একটি পর্বকে অন্য পর্বটির থেকে দুর্বল কিংবা বিচ্ছিন্ন মনে হয়নি। সংলাপ ও বর্ণনাকে নির্দেশক এমন চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, পুরোটা সময়জুড়ে দর্শকদের মনোসংযোগ শ্লথ হওয়ার কোনো অবকাশই তৈরি হয়নি। প্রচুরসংখ্যক বর্ণনাত্মক নাটকে সচরাচর এ-ঘটনা ঘটে থাকে। সিদ্ধার্থ সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এমন কী বুদ্ধের দর্শনের কথাগুলিও বর্ণনা ও বলিষ্ঠ সংলাপ প্রক্ষেপণে অত্যন্ত সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন নির্দেশক রেজা আরিফ। বর্ণনাত্মক নাটকে সাধারণত দেখা যায়, বর্ণনাকারী বর্ণনা করতে করতে চরিত্রে প্রবেশ করেন। অথবা চরিত্র থেকে বর্ণনায় চলে আসেন। এতে এক ধরনের এলিনিয়েশন কিন্তু ঘটেই যায়, যদিও তা ব্রেখটীয় এলিনিয়েশন নয়। ব্রেখটীয় এলিনিয়েশনের একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। এ-নাটকের উদ্দেশ্য তার থেকে ভিন্ন। ‘সিদ্ধার্থ’ নাটকে রেজা আরিফের উপস্থাপনাভঙ্গিটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাঁর চরিত্ররা যখন বর্ণনা দিচ্ছে, সেটাও অনেকাংশেই সংলাপ হয়ে উঠছে, যদিও তা সংলাপ নয়। এই চমৎকার বাচিক-ছাঁচটি এ-নাটকটিকে অভিনবত্ব দান করেছে।

এই নাটকের মূল থিমটি বেশ স্পষ্ট। বুদ্ধের মতে, যা আনন্দের নয়, যা সুখের নয়, যা প্রত্যাশার নয়, যা বরণের নয়, যা প্রেমের নয়, যা খুশির নয় – তা-ই দুঃখ। দুঃখ থেকে চিরমুক্তির নাম নির্বাণ। পুরো নাটকের অন্তরাত্মাজুড়ে বুদ্ধের দর্শনের এই নির্বাণলাভের বিষয়টি বারবার বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে। কিন্তু বুদ্ধদর্শন ও বৌদ্ধশাস্ত্রের আর একটি মুখ্যবিষয় ‘অষ্টমার্গ’ সম্পর্কিত কথাবার্তা উচ্চারিত হয়েছে কম। নির্বাণলাভের কথা যত প্রবলভাবে উঠে এসেছে, অষ্টমার্গের কথা ততই দুর্বল ছিল। অথচ নির্বাণলাভের জন্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা অর্থাৎ সৎ বাক্য, সৎ কার্য, সৎ জীবন বা জীবিকা, সৎ চেষ্টা, সৎ চিন্তা, সৎ চেতনা বা দৃষ্টি, সৎ সংকল্প ও সৎ বা সম্যক সমাধির কথা বলাও তো সমান জরুরি ছিল। এ কি হেরমান হেসের ঘাটতি, নাকি রেজা আরিফের? 

সংসারজীবন ত্যাগ করে সিদ্ধার্থ নদীর কাছে থাকতে শুরু করেন। নদীর কাছ থেকে সিদ্ধার্থ নদীর ভাষা বুঝতে চান, জীবনের মানে বুঝতে চান। উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন মানবজীবনের গভীরতর অর্থ। সিদ্ধার্থ নাটকে নদীর কথা বলা হয়েছে, প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। আজ সারাবিশ্বের সচেতন মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবেসে তার বুকেই আশ্রয় নিতে চাইছে। প্রকৃতিবাদীদের মতো করে না বলেও এ-নাটকে সেই কথাটিই বেশ প্রবলভাবে উঠে এসেছে।

সিদ্ধার্থ এ-সময়ের অত্যন্ত বলিষ্ঠ প্রযোজনা। দুর্দান্ত টিমওয়ার্ক। অভিনেতা-অভিনেত্রী ও নেপথ্যের কুশীলবদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সিদ্ধার্থ টোটাল থিয়েটার হয়ে উঠেছে। নাটকটিতে কাজী নওশাবা আহ্মেদ, পার্থ প্রতিম হালদার, নাজমুল সরকার নিহাত, মাঈন হাসান প্রমুখের অভিনয় প্রশংসনীয়। মাঈন চরিত্রকে চমৎকারভাবেই ধারণ করতে পেরেছেন, তবে তাঁর ঈষৎ কুঁজো হয়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল না। এ-নাটকে আরো যাঁরা অভিনয় করেছেন তারা হলেন – ওয়াহিদ খান সংকেত, ইসনাইন আহমেদ জিম, শাহাদাত নোমান, জিনাত জাহান নিশা, রেফাত হাসান সৈকত, আরিফুল ইসলাম নীল, আকাশ তুহিন, পলি পারভীন, মাইন উদ্দিন বাবু, জেরিন চাকমা, ক্যামেলিয়া শারমিন চূড়া, রাফিদা নারমিন, আজমেরী জাফরান রলি, প্রজ্ঞা প্রতীতি, ইমাদ ইভান. জিতাদিত্য বড়ুয়া, সারিকা ইসলাম ইষিকা, প্রিন্স সিদ্দিকী। তবে গোবিন্দ, প্রধান পুরোহিত ও বণিক চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের আরো পরিশ্রম করতে হবে চরিত্র তিনটি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য।

সিদ্ধার্থ নাটকে সংগীতের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সাদমান রাব্বি অন্তরের তত্ত্বাবধানে পুরো টিম সে-ভূমিকা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। অনিক কুমার নিরাভরণ মঞ্চ, প্রপস ও সামান্য আভরণের আলোয় সিদ্ধার্থের বিশাল ক্যানভাস উন্মোচন করতে পেরেছেন। এ-নাটকে পোশাক ও কোরিওগ্রাফির জরুরি কাজটি চমৎকারভাবে করেছেন জিনাত জাহান নিশা, নুসরাত জাহান জিসা ও আকাশ সরকার। দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহারও ছিল নান্দনিক।

সবশেষে মানতেই হয়, রেজা আরিফ সিদ্ধার্থ নাটক নির্মাণে সিদ্ধিলাভ করেছেন। আবারো তিনি প্রমাণ দিলেন 888sport appর মঞ্চে তিনি কতটা মেধাবী ও প্রয়োজনীয় নির্দেশক। জয় হোক আরশিনগরের। জয়ী হোক সিদ্ধার্থ।